ইলিশের প্রজনন মৌসুম উপলক্ষে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার উপর টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা গত ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে। ফলে কক্সবাজার শহরের ফিশারিঘাটস্থ প্রধান মৎস্য অবতরণকেন্দ্রসহ জেলার অন্যান্য সামুদ্রিক ঘাটসমূহ খা খা প্রান্তরে পরিণত হয়েছে। অলস সময় কাটছে জেলার লক্ষাধিক জেলে, মৎস্য শ্রমিক ও ব্যবসায়ীর। কক্সবাজারের শহরের সমুদ্র ও নদী তীরবর্তী অঞ্চল পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ড ও ২ নং ওয়ার্ডের অধিকাংশ বাসিন্দা এবং ৩, ৪, ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা মৎস্য পেশার সাথে জড়িত। এছাড়া শহরতলীর খুরুশকুল থেকে উত্তরদিকে মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া ও দক্ষিণ দিকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ–পরোক্ষাবে মৎস্য পেশার উপর নির্ভরশীল। নিষেধাজ্ঞার পর এসব জেলে পল্লীগুলোতে কর্মচাঞ্চল্য থেমে গেছে। মিলিয়ে গেছে মুখের হাসি। বলছিলেন কক্সবাজার জেলা ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার মোস্তাক আহমদ।
তিনি বলেন, কক্সবাজার জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে অন্তত ৭০ হাজার জেলে পরিবারের পাশাপাশি রয়েছে মাছ বহন, লোড আনলোড, প্রক্রিয়াজাতকরণসহ মৎস্যের সাথে বিভিন্নভাবে জড়িত আরো অন্তত ত্রিশ হাজার নারী পুরুষ শ্রমিক। গত ১২ অক্টোবর থেকে সাগরে একটানা ২২ দিনের জন্য মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেছে। এরফলে জেলে, শ্রমিক ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে জড়িত নারী পুরুষ মৎস্য শ্রমিকরা বেকার হয়ে রয়েছে।
কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত সাগরতীরের গ্রাম শামলাপুর। টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় ইউনিয়ন বাহারছড়ার প্রাণকেন্দ্র এটি। এখানকার মানুষের প্রধান পেশা সাগরে মাছ ধরা। এখানে নেই কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কলখারখানা। ফলে সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে এই জনপদের জেলে পরিবারগুলোতে নেমে আসে অভাব অনটন। সেসাথে সাগরকে কেন্দ্র করেই চলে এই জনপদের প্রায় সব ব্যবসা বাণিজ্য। সাগর থেকে মাছ ধরতে পারলে উপকূলের দোকান পাটের ব্যবসা চলে। আর সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকলে এই বাজার এক প্রকার নির্জীব হয়ে পড়ে বলে জানান শামলাপুর বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি মাস্টার এমএ মঞ্জুর।
টেকনাফের শামলাপুরের মতোই কক্সবাজার শহরের ফিশারীঘাট, মাঝিরঘাট, দরিয়ানগর, রেজু, ইনানী, নিদানিয়াসহ সমুদ্র উপকূলীয় জেলে পল্লী কেন্দ্রিক বাজারগুলোতে এখন চাঞ্চল্যহীন নিস্তব্ধতা।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, মাছ ধরা বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কক্সবাজারের ২৩ হাজার ৪০ জন নিবন্ধিত জেলের মাঝে ২৫ কেজি করে চাল প্রদান করা হবে।
তিনি বলেন, আগামী ২ নভেম্বর পর্যন্ত সাগর ও মোহনায় মাছধরা, পরিবহণ ও মজুদের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। কেউ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করা হবে।
কক্সবাজার জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির মতে, কক্সবাজার জেলায় ছোট বড় প্রায় ৮ হাজার নৌ–যান রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৩শ ট্রলার শহরের ফিশারীঘাট থেকে সাগরে আসা–যাওয়া করে। আর বাকী ট্রলারগুলো জেলার অন্যান্য ঘাট থেকে মাছ ধরতে যায়। আকার ভেদে একেকটি বড় নৌযানে ৩০ থেকে ৪০ জন এবং ছোট নৌ–যানে ৫ থেকে ১৭ জন জেলে থাকে। আবার কক্সবাজার শহরতলীর দরিয়ানগর ঘাটের ইঞ্জিনবিহীন ককশিটের বোটে থাকে মাত্র ২ জন জেলে। এরমধ্যে ইলিশ জালের বোটগুলো গভীর বঙ্গোপসাগরে এবং বিহিন্দি জালের বোটগুলো উপকূলের কাছাকাছি মাছ ধরে থাকে। যে কারণে ইলিশ জালের বোটগুলো পক্ষকালের রসদ নিয়ে এবং বিহিন্দি জালের বোটগুলো সাগরে মাত্র একদিনের রসদ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। বিহিন্দি জালে ইলিশ ব্যতীত ছোট আকারের প্রায় পাঁচ প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘পাঁচকাড়া’ (পাঁচ প্রকারের) মাছ বলা হয়। নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন সকল ধরনের মাছ ধরা বন্ধ রয়েছে।