প্লাস্টিকের পাশাপাশি দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার বেড়েছে ককশিটের। কিন্তু প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আলোচনা থাকলেও কর্কশিট নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথা নেই কারোই। এছাড়া ব্যবহার পরবর্তী কর্কশিট যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের, তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। এ নিয়ে পরিবেশ বিষয়ক সেবা সংস্থার কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প দেখা যায়নি।
জানা যায়, ককশিটের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি মাছ সংরক্ষণের কাজে। জেলেরা মাছ ধরে বিক্রি, এরপর দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ সব কাজে ককশিট ব্যবহার করেন। দেশে কিংবা বিদেশে মৎস্য বাণিজ্যের কাজেও ব্যবহার রয়েছে ককশিটের। এছাড়া ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের সুরক্ষা, ওয়ানটাইম প্লেট থেকে শুরু করে নির্মাণ শিল্প, এভিয়েশন খাত সব জায়গায় ব্যবহার বেড়েছে ককশিটের। ঘর সাজানোসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে এটির ব্যবহার রয়েছে। গত এক দশকে এর ব্যবহার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। স্বল্প সময়ের জন্য এই পণ্যটির ব্যবহার হলেও পরিবেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যায় দীর্ঘদিন। প্লাস্টিক রিসাইকেল করে পুনরায় ব্যবহার করা গেলেও ককশিটের কোনো রিসাইকেল করা হয় না। নগরের চেরাগী মোড়ে ফুল দোকানগুলোতে দেখা যায় এর ব্যাপক ব্যবহার। ফুলের ঢালা কিংবা অনুষ্ঠানের বাহারি রকমের সাজের জন্যও ককশিটের জুড়ি নেই। স্বল্প সময়ে নান্দনিক সাজে সজ্জিত করার জন্য কর্কশিটই যেন শেষ ভরসা। কিন্তু এসব ব্যবহারের পর ময়লা–আবর্জনার মতোই যত্রতত্রভাবে ফেলে দেওয়া হচ্ছে যেখানে–সেখানে।
জলাবদ্ধতার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নালা নর্দমায় ব্যাপক হারে বেড়েছে ককশিটের বর্জ্য। এসব বর্জ্যের কারণে পানি নিষ্কাশনে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। যার ফলে নগরের বিভিন্ন এলাকায় স্বল্প বৃষ্টিতেও তৈরি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। সড়কের পাশে কিংবা ডাস্টবিনেও দেখা যায় কর্কশিটের স্তূপ।
ব্যবসায়ীরা জানান, এখন ব্যাপক হারে বেড়েছে ককশিটের ব্যবহার। যেকোনো পণ্যের সঙ্গে মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এটি। টিভি, ফ্রিজসহ কাচের পণ্যের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে কর্কশিট। এটি দামে কম এবং যেকোনো সাইজের পাওয়া যায়। বিদেশ থেকে অনেক পণ্য আসে কর্কশিটে মোড়ানো। চাইলেও এর ব্যবহার কমানোর সুযোগ নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণা তথ্য মতে, বিশ্বে ককশিটের ব্যবহার এশিয়া পেসিফিক অঞ্চলে বেশি। চীন ও ভারতে এর ব্যবহার রেকর্ড ছাড়িয়েছে। বিশ্বে প্রতি বছর ১৬৫ বিলিয়ন প্যাকেজ কর্কশিট ব্যবহৃত হয়। যার বাজারমূল্য ১৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা প্রতি বছর ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী এটি পরিচিত থার্মোকল হিসেবে। থার্মোকল হলো পলিস্টাইরিনের আরেক নাম। এটি একটি সিন্থেটিক অ্যারোমেটিক পলিমার যা মনোমার স্টাইরিন থেকে তৈরি। এটি ১০০ বছরেরও অধিক টিকে থাকতে পারে পরিবেশে।
জানা যায়, গত ২৪ আগস্ট বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপনে পরিবেশ দূষণ রোধকল্পে কিছু পণ্য ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং দ্রুত নগরায়ণের ফলে প্লাস্টিক দূষণ, বিশেষ করে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক সামগ্রী (একবার ব্যবহারের পর অকেজো পণ্য) হতে সৃষ্ট দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের গৃহীত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করার লক্ষ্যে ‘কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ বিধি–৯ এর আলোকে সরকার তালিকাভুক্ত বস্তু বা সামগ্রী বা পদার্থকে ‘সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই প্রজ্ঞাপনে ১৭টি বস্তু বা সামগ্রী বা পদার্থের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ নম্বরে একবার ব্যবহারযোগ্য তৈজসপত্র বা কার্টলারি এবং ৯ নম্বরে টাইরোফোমের খাবার মোড়ক বা ধারক দুইটি কর্কশিট থেকে নির্মিত পণ্য বা বস্তুর কথা উল্লেখ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, এর বাইরেও অনেক পণ্য আছে যেগুলো কর্কশিট থেকে তৈরি হয়। সেগুলোর ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত আসা উচিত।
এই ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক শ ম বখতিয়ার আজাদীকে বলেন, প্লাস্টিকের পাশাপাশি কর্কশিট আরও বেশি ক্ষতিকর পরিবেশের জন্য। পলিথিন পানিতে ডুবে যায়, কর্কশিট ভেসে থাকে। যার কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। আর এটি দীর্ঘ সময় পরিবেশে টিকে থাকে। এটি পচেও না, মাটির সঙ্গে মিশেও যায় না। এজন্য এটি ব্যবহার পরবর্তী ফেলার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, কর্কশিটের ব্যবহার বহুমুখী। নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে বা কোনো জিনিস কিনলে সেটার সঙ্গে কর্কশিট দেওয়া হয়। এটি যেহেতু একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়, এজন্য সচেতনতা জরুরি। এ ব্যাপারে সচেতন হলে ক্ষতিকর প্রভাব অনেকটাই আসবে বলে আশা করেন তিনি।