ওয়ার ইন ইউক্রেন

ডা. দুলাল দাশ | শুক্রবার , ১৩ মে, ২০২২ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

ইউক্রেন ইউরোপীয় একটি দেশ যেটার সীমান্ত বর্ডার রাশিয়ার সাথে লাগানো। দেশটা মোটামুটি সম্পদশালী ও তাদের ভূমি উর্বর। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ হঠ্যাৎ করে বিনাউসকানীতে এক তরফা ভাবে বৃহৎ শক্তিধর রাশিয়া তার সামরিক শক্তি দিয়ে ইউক্রেনকে আক্রমণ করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমি পুতিন যুদ্ধের কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হতে চায় এবং ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী অঞ্চল দানবাসে বসবাসরত রাশিয়ানদের সাথে দুর্ব্যবহার ও নির্যাতন করে। কিন্তু পুতিনের আসল উদ্দেশ্য ন্যার্টো সম্প্রসারণ বন্ধ, আগ্রাসন এবং আঞ্চলিক দখলদারিত্ব। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের দুই মাস পর হয়েছে। কয়েকদিন আগে জাতিসংঘ মহাসচিব মস্কো এবং ইউক্রেন রাজধানী “কিয়েভ” ঘুরে গেছেন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের মতে এ যুদ্ধ সহজে থামবার নয়। কয়েক বছর চলতে পারে। এ দু’মাসের যুদ্ধে বহু শহর বন্দর, গ্রাম, বড় বড় শিল্প কারখানা, প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ নিরীহ ইউক্রেনবাসী তাদের সহায় সম্বল ছেড়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে, ট্রেনে বা গাড়িতে বিভিন্ন দেশে পালিয়েছে এখনও পালাচ্ছে। বাস্তচ্যুত ইউক্রেন নাগরিকরা আজ রিফিউজি। যেমন ১৯৭১ সালে ঘটেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লোক শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। আগ্রাসী পাকিস্তানি আর্মি গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়েছিল।

হাজা হাজার নিরাপরাধ লোককে ধরে নিয়ে গুলি করে মেরে ছিল। প্রতিদিন টেলিভিশন খবরে দেখানো হয় ইউক্রেনের ধ্বংসযজ্ঞ। পুতিন হুঙ্কার দিচ্ছে প্রয়োজনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে। ইউক্রেনের আকাশে ঝঁাঁকে ঝাঁকে বোমারু বিমান আর মাটিতে সাজোয়া ট্যাঙ্ক বহর নিত্যদিনের ব্যাপার মিসাইল আক্রমণ অব্যাহত আছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুদ্ধের শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে আলোচনাও শান্তির প্রস্তাব দিয়ে আসছেন এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশগুলিকে আহ্বান জানিয়ে আসছেন যুদ্ধ থামাতে ও শান্তি আলোচনায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে। কিন্তু কোন গোষ্ঠী বা দেশ তাতে সারা দেয়নি। তবে সে সমস্ত দেশগুলি এবং বিশ্ব সংস্থা বিভিন্ন অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করে রাশিয়াকে কিভাবে আর্থিক দুর্বল করা যায় তার কার্যকর ভূমিকা নিয়েছেন। একই সাথে ঐ দেশগুলি এবং ন্যাটোভুক্ত কিছু দেশ ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, তাদের এই পলিসি যুদ্ধকে আরো দীর্ঘয়িত করবে। তাতে আরো বেশি ইউক্রেনীয়রা দেশ ছেড়ে পালাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে শহর, শিল্প, অর্থনীতি সাথে বেড়ে যাবে যুদ্ধাপরাধ। এভাবে আগ্রাসন চলতে থাকলে আগামীতে ‘ডেসার’ মত শহরগুলি পোর্ট সিটি মারিয়াপোলের মত ধ্বংস হয়ে যাবে। কেন পশ্চিমারা এ যুদ্ধে জড়াচ্ছে না তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝঁুঁকি। বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার সাথে তুলনামূলক অনেক কম শক্তি সম্পন্ন ইউক্রেন কী ভাবে দুই মাসের উপর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সবার মনে প্রশ্ন-ইউক্রেনবাসী ও তার সেনাবাহিনী ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় পরাক্রমশালী জার্মানদের সাথে যে রণকৌশল অবলম্বন করেছিল এই যুদ্ধেও সেটা অবলম্বন করছে। সেই কৌশলটির নাম “হিট অ্যান্ড রান” অর্থাৎ ইউক্রেন বাহিনীর গেরিলা আক্রমণ একটা হলো “খাদ্য যুদ্ধ”। এটা জানতে পারা গেছে নামকরা সাংবাদিক নাতালিয়া গুমিনার থেকে যিনি জীবন বাজি রেখে রাজধানী কিয়েভে ঢুকেছিলেন। “খাদ্যযুদ্ধটা হল-নিজেরা কম খেয়ে টিকে থাকা ও আক্রমণকারীরা যাতে খাদ্য রসদ না পায় সেজন্য দ্রুত খাদ্য লুখিয়ে রাখা। এই পলিসির সামনে টিকতে না পেরে ইতোমধ্যে রাশিয়ানরা কিয়েভ থেকে সরে আসছে।

সেখানে তাদের অনেক সৈন্য ক্ষয় হয়েছে। যেমনটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাতৃভূমির টানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বীরবিক্রমে মন প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করেছিল তাদের সহ যোদ্ধা ছিল স্থানীয় জনগণ। সে সময় শক্তিশালী পাকিস্তানি আর্মি যেহেতু তারা পশ্চিম পাকিস্তানের লোক তারা সে রকম যুদ্ধ করতে পারেনি। জনগণের সহায়তাও পায়নি। যেমনটি হয়েছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধে র্স্টালিন ইউক্রেনের উর্বর কৃষি জমিগুলি সরকারি করার ফলে কৃষিতে সফল হয়নি। দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল। কারণ প্রকৃত কৃষক ছিল ইউক্রেনবাসী শোনা যায় বাঙালিরাও এক সময় মারাটা, নোঙ্গল প্রভৃতি বহু আক্রমণকারীকে জব্দ করার জন্য এই খাদ্য যুদ্ধ চালিয়েছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ফান্স জয়ের পর ব্রিটিশ নেতা চার্চিল ১৯৪০ সালে ১৩ই মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভাষণে যে কথাগুলো বলেছিলেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি একই কথা বলছেন আমরা থামব না। যুদ্ধ চালিয়ে যাবো আমাদের রণকৌশল নিয়ে আমরা ভূমিতে সাগরে জঙ্গলে মাঠে রাস্তায় যুদ্ধ করব। ঈশ্বর আমাদের যেটুকু শক্তি দিয়েছেন তাই দিয়ে সম্প্রতি রাশিয়ার কিছু এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। সেই সুবাদে বেঁচে যাওয়া কিছু লোক মাটির নিচ থেকে, ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে আসে। দুজন লোক হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা একজন আরেক জনের দিকে আসছে। একে অপরকে চেনার আগে কান্না শুরু করে দেয়। কারণ তারা বেঁচে আছে। একে একে অনেক নারী পুরুষ বেরিয়ে আসলো। সেকি দৃশ্য! “বলে আমরা বেঁচে আছি? সীমান্তবর্তী ছোট স্পা শহরের ঘটনা যেখানে মাত্র ২০ হাজার লোকের বাস। সে শহর দখলের পর টেলিফোন সেলুলার নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়। আলো বলতে শুধু মোমবাতি খাবারও প্রায় শেষের দিকে। এরই মধ্যে ইরফান ও অন্যান্য শহর দখলমুক্ত হয়। নগরবাসী দেখলো চারদিকে শুধু ধ্বংসযোগ্য। তারা কান্না জড়িত কণ্ঠে রাশিয়ানদের নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতনের মুখে অনেক যুবকের প্রাণ গেল এক যুবককে ইন্টারোগেশন করার সময় তার মা সেখানে উপস্থিত হয়ে হাঁটু গেড়ে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চান। সে সময় ককেশিয় অঞ্চলে এক সৈন্য দয়াপরাবশ হয়ে তাকে ছেড়ে দেয়।

বেলা ৩টার পর বের হলেই গুলি তাতে একজন সাইক্লিস্ট ও অপরজন যার স্ত্রী সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল-নিহত হন। ৬০ বছর বয়সী এক আফগান যুদ্ধ ফেরত তাকে বাড়ি ছাড়তে বলেছিল-না ছাড়াতে গুলিতে মারা গেল। পুরো উলঙ্গ করে দেখা হয় শরীরে ‘ফুলকী’ আছে কিনা। কারণ ইউক্রেন সেনাদের শরীরের ফুলকী চিহ্ন থাকে। রাশিয়ানরা পর্যটন শহর কীয়েভে ঢুকেছিল। এই শহরে ১৭৪৯ সাল থেকে বিখ্যাত ‘নিওগোথি স্টাইলের বিশাল পোলচত্বর রয়েছে। বিখ্যাত চকলেট ফ্যাক্টরী এবং যাদুঘর ই্‌ শহরে। এখানে শাইকো ভস্কি ১৮৬৪ সালে তার বিখ্যাত ‘দিস্টর্ম’ কমপোজ করেছিলেন। রুশ সৈন্যরা এর মধ্যে ৪০০ শত হাসপাতাল ধ্বংস করে দিয়েছে। রুশরা প্রথম দখল করে ঐতিহ্যবাহী শহর ‘ইস্তয়ালেট’। অবশ্য কয়েক সপ্তাহ পর ছেড়ে দেয়। এমন ধ্বংসযোগ্য চালিয়ে ছিল ইউক্রেনিয়ারা মনে করলেন অচেনা ভূতুড়ে নগরী। দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ইউক্রেনের পশ্চিমের শহর ‘লিভ’ এ কান পাতালেই বোমারু বিমানের শব্দ ও বোমাবাজি। কিছুক্ষণ পর পর সাইরেনের শব্দ। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে মেট্টোস্টেশনে, বড় বড় গুদাম ঘরে, স্টীল প্ল্যান্টে বাংকারে শতাধিক নারী শিশু এক মাস ধরে মারিয়া পুলে এক সুরঙ্গে লুকিয়ে ছিল সম্প্রতি তাদের বাহির করা হয়। দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ দিকে পুতিন মাঝে মাঝে ৩য় বিশ্ব যুদ্ধের ভয় দেখাচ্ছে পুতিন এটাও বলতেছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলি ইউক্রেনকে যদি সমরাস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে তবে যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে।
এই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলতে হয় কেন এই রকম যুদ্ধ হবে? কেন মারা পড়বে বৈসামরিক লোক? নারী নিষ্পাপ শিশু? কী তাদের অপরাধ? কত হাজার হাজার শিশু যুদ্ধের কারণে পরিবার থেকে বিচিন্ন হয়ে গেছে? এ এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। কবি বলে গেছেন এই পৃথিবী মানবের তরে-দানবের তরে নয়। কিন্তু আমরা কি দেখছি সর্বত্রই এ পৃথিবী দানবের দখলে চলে যাচ্ছে।

পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা এই যুদ্ধ অতি সত্বর বন্ধ হয় তবেই সকলের মঙ্গল। যুদ্ধের ফলে ভোগ্য পন্য থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। দারিদ্রপীড়িত লোকদের নাভিশ্বাস মানব জাতি আর কত ধ্বংস দেখবে প্রাকৃতিক দুযোর্গ, মনুষ্যসৃষ্ট যুদ্ধ বিগৃহ ও হানাহানি আর কত সহ্য করবে।

লেখক : প্রাক্তন চীফ এ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যবিধি মানতে এত অনীহা কেন?
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা