চঞ্চল–চপল কিশোরটি গরুর লড়াই দেখতে খুব পছন্দ করতেন। বাবা মৌলভী নছিহউদ্দিন যখন লাইল্যার (তাঁদের লাল গরুটি লড়াইয়ের জন্য খ্যাত ছিল) শিং জৈতুনের তেল মেখে চকচকা ভাব আনছিলেন তখন ছোট ছেলে ওহীদ বোতল ভাঙ্গা কাঁচ এনে দিল শিং দু’টো যেন আরো মসৃণ ও সরু হয়। বাড়ির পূর্বদিকের বিশাল বিলে যতবার গরুর লড়াই হয়েছে মৌলভী নছিহউদ্দিনের ‘লাইল্যা’ জিতে এসেছে। ওহীদুল আলম ‘লাইল্যার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। ফতেয়াবাদের অজপাড়া গাঁর হারিক্যানের আলোতে লেখাপড়া করেই মেট্রিকুলেশন পাস করেছিলেন ওহীদুল। বড় ভাই শামসুল আলম ইংরেজি সাহিত্যের অনুরাগী। তাঁর মুখে শেক্সপিয়রের কবিতা শুনে আপ্লুত হয়েছিলেন তিনি। মেজভাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক হয়েও যখন লেখালেখিতে নিমগ্ন হলেন তখন ছোটভাই ওহীদ উদ্বুদ্ধ হলেন গল্প–কবিতা লেখায়। মেজভাই দিদারুল আলম পুরোদস্তুর কোলকাতার সুধী সমাজে কবি হিসাবে সমাদৃত হতে লাগলেন। তাঁর সাথে যুক্ত হলো কবি নজরুলের সান্নিধ্যের মহিমা। ফলে চারভাই নিয়ে গড়ে ওঠা ‘মৌলভী পরিবার’ হয়ে ওঠল বিখ্যাত ‘আলম পরিবার’। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ওহীদুল আলমের দু’চোখ ভরে জেগে ওঠল বড় হওয়ার স্বপ্ন। নিঝুম পাড়া গাঁ ফেলে একাকী শহর পানে পথ চলা শুরু করলেন তিনি। পায়ে হেঁটে ফতেয়াবাদ থেকে শহরে এসেছিলেন কয়েকবার। অর্থের যোগান তেমন ছিল না, তবে বুকে সাহস ও চোখে স্বপ্ন ছিল বলেই হেঁটে হেঁটে শহরে আসেন আবার বাড়িতে ফিরে যান। বড় ভাই শামসুল আলমের মৃত্যুর খবর শুনে তো তিনি রেল লাইন ধরেই পায়ে হেঁটে রেঙ্গুন চলে গিয়েছিলেন। এমন অদম্য ওহীদুল আলম তারুণ্যের সারল্যে যে স্বপ্ন বুনেছিলেন তা দীর্ঘ পথ চলাতেও সম্পন্ন করতে পারেননি। একাকী শহরে এসে শিক্ষকতা করেছেন, পত্রিকা সম্পাদন করেছেন, বই লিখেছেন, জমি কিনে ‘আলমবাগ’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে ‘আলমবাগ’ নিয়ে ডায়েরিতে যে স্বপ্নের আঁকিবুঁকি করেছিলেন তাঁর উত্তরাধিকাররা আমলে না নেয়ায় এই জীবন সংগ্রামী দুরন্ত ওহীদুল আলম এখন বিস্মৃত এক নাম। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী এবং স্বপ্নবাজ এই সাধকটি অজপাড়া গাঁ থেকে এসে শিক্ষক ও কবি হিসাবে চট্টগ্রামে সম্মানের যে বাগান রচনা করেছিলেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তাতে একটি ফুলও ফোটাতে পারেননি। কেউ কেউ কবি–পুত্র পরিচয় দিলেও সমাজ তাতে নিশ্চুপ। ১৯২৯ ইংরেজির ২৬ জানুয়ারি দিদারুলের আমন্ত্রণে নজরুল তাঁদের বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। তবে সে সময় ওহীদ বাড়িতে ছিলেন না। তবে ১৯৩০ সালে রাউজান সাহিত্য কনফারেন্সে কবি নজরুল দ্বিতীয় বারের মতো চট্টগ্রাম এলে ওহীদুল আলম তাঁর উদ্দেশ্য নিবেদন করে একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান। তরুণ ওহীদুলের কবিতা শুনে কবি আপ্লুত হয়ে পিঠে মৃদু চড় দিয়ে বলেছিলেন ‘দিদার তোমার এই ভাইটা একদিন বড় কবি হবে’। মূলত এই উৎসাহ বাণী ওহীদুল আলমকে কবিতা চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে এবং সে সময় নিয়মিত কলকাতার মোহাম্মদী, বুলবুল, নবশক্তি, মুয়াজ্জিন নামক বিভিন্ন পত্রিকায় গল্প–কবিতা নিয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। অজপাড়া গাঁ’র ওহীদুল চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন ১৯৩৬ সালে। সে সময় বি.এ ডিগ্রি মানে সর্ব বিষয়ে বিশারদ। বাংলা ও ইংরেজি চর্চায় তাঁর দক্ষতা পরবর্তী সময়ে গুরুজনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। চট্টগ্রাম কলেজের সে সময়কার শিক্ষক জনার্দন চক্রবর্তী কলকাতায় গিয়ে তাঁর এই ছাত্রকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ওহীদুল আলমের বয়স তখন সত্তুর, শিক্ষকের পত্র পেয়ে শিশুর মতো অঝোর ধারায় কেঁদেছিলেন তিনি।
আমি নিজেও এই চিঠি পড়েছি। পোস্ট কার্ডে লেখা চিঠি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রকৃত শিক্ষক কীভাবে তাঁর ছাত্রকে বার্ধক্যকালে স্মরণ করলেন তা পড়ে যে কেউ অভিভূত হবেন। মূলত বি.এ পাস করার পর ওহীদুল আলম মাসিক পূরবী নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন। তিনি মেজভাই মাহবুব উল আলম ও সাহিত্যিক আবুল ফজলের সহযোগিতায় চট্টগ্রামে পূরবী সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেন ১৯৩৭ সালে। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। সাহিত্যিক অন্নদা শংকর রায় (তখন চট্টগ্রামের এডিসি) এবং কাজী আবদুল ওদুদ এ সম্মেলনে যোগদান করে নতুন মাত্রা যোগ করেন। এই সাহিত্য সম্মেলন সফল করতে প্রায় এক মাস ওহীদুল তাঁর বাল্যবন্ধু (কবি) আবদুস ছালামকে সাথে নিয়ে দিন–রাত পরিশ্রম করেছেন। কবি নজরুলের একটি বাক্য ওহীদুল আলমকে কী পরিমাণ অনুপ্রাণিত করেছিল তা যাঁরা সে সময়ে পূরবী সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন সবাই এক বাক্য স্বীকার করেছিলেন। ওহীদুল আলম সাহিত্য চর্চায় গভীরভাবে নিমগ্ন হয়ে পড়েন। প্রকৃতি নানা রূপে তার দৃষ্টিতে ধরা পড়তে থাকে। উদাস মনে প্রকৃতি দেখতে দেখতে তিনি কবি হয়ে ওঠেন। বাংলার মাইকেল, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্র, নজরুল ছাড়াও ইংরেজির শেক্সপিয়ার, উর্দুর ইকবাল, ফার্সির অনেক কবি সাহিত্যিকের লেখা ওহীদুল আলম পাঠ করেছিলেন। তিনি স্কুল জীবনে ফার্সি ও উর্দু ভাষা রপ্ত করেছিলেন। জীবনযুদ্ধে অর্থের প্রয়োজনে তিনি ১৯৩৮ সালে সীতাকুণ্ডের একটি বেসরকারি হাই স্কুলে শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৩৯ সালে কুমিল্লায় আয়োজিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যে সময় দুই বাংলায় বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিলো। তবে একটি গানকে কেন্দ্র করে এই সম্মেলনটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। কবি মোতাহের চৌধুরীর নেতৃত্বে সাহিত্যিক সাদৎ আলী আকন্দসহ ওহীদুল আলম সম্মেলন বয়কট করেন। ১৯৪০ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.টি (বর্তমানে বি.এড) পাশ করে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে সাহিত্যিক আবুল ফজলের লীভ ভেকেন্সীতে তিনি শিক্ষকতায় যোগদান করেন। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে মহসীন কলেজ) বাংলার শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এটি তাঁর জীবনে প্রথম সরকারি চাকরি। ১৯৫৮ সালে তিনি যোগ দেন চট্টগ্রামের সবচেয়ে নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৭২ সালে কলেজিয়েট স্কুল থেকে বদলি হয়ে বাকলিয়ায় নবপ্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম চিটার্স ট্রেনিং কলেজে সুপারিন্টেডেন্ট হিসাবে যোগদান করেন। অবশ্য এক বছর শিক্ষকতা করে তিনি অবসরে যান। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের অনুরোধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। একজন স্বভাবজাত কবি হয়েও তিনি শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। শিক্ষকদের একটি স্বাভাবিক চরিত্র থাকে। কিন্তু ওহীদুল আলম বাংলার শিক্ষক হয়েও শিক্ষার্থীদের ইংরেজি সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর পাঠ দিতেন। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের হাজিরা খাতায় নাম ডাকাকে তিনি পছন্দ করতেন না। তাই ক্লাশে এসেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু করে মূল বই থেকে পড়াতেন তারপর শেখ সাদী কিংবা মাইকেলের কবিতা দিয়ে ক্লাশ শেষ করতেন। মূলত এ কারণে ওহীদুল আলমের ক্লাশে পড়ার চাপ ছিল না। সব শিক্ষার্থী নিমগ্ন হয়ে সাহিত্যের ভেতর ডুবে যেত। বর্তমানে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন করেই সাজানো হচ্ছে। যাতে শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বইয়ের পাঠ নিয়ে ভীত না হয়। গ্রাম্য বালক ওহীদুল নগর জীবনে এসে সম্পূর্ণ অপরিচিত পরিবেশে জীবনযুদ্ধে উৎরে গেলেন। কথাশিল্পী আবুল ফজলের সাহিত্য নিকেতনের পেছনে কাজী বাড়ির ভাড়াটিয়া হয়ে পরিবার নিয়ে সংসার সাজিয়ে ছিলেন তিনি। টানাটানির সংসার হলেও পাঠানটুলীর খান বংশের মেয়ে জরিনা খানম কোন অভাবকে অভাব মনে করেননি। স্বামীর বাউলিয়া মনকে তিনি ভালভাবেই রপ্ত করেছিলেন। স্কুলের শিক্ষকতা ও লেখালেখিতে যা উপার্জন তা দিয়ে তিন কন্যা সন্তান নিয়ে সুখের স্বপ্ন বুনেছিলেন এই দম্পতি। বড় ও মেজ–দু’কন্যাকে খাস্তগীর স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে শিক্ষক দম্পতি চাইলেন শহরের বুকে এক টুকরো জমি কিনতে। কিন্তু যা উপার্জন তাতে সংসার চলে না। তবুও স্বপ্ন বুনেন তাঁরা। বড় মেয়ে নিলুফার বলে লেখাপড়া ও খেলাধূলার জন্য এই বাসার পরিবেশটা ভাল নয়। শিক্ষক বাবাও বুঝেন এখানে বিহারী ছেলেদের উৎপাত বেশি।
তাঁরা ছাড়া তথাকথিত এক হুজুর সারারাত ‘জ্বীন’ হাজির করে ‘হৈ–হুল্লোড়’ করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ওহীদুল আলম গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। বড় মেয়ের অভিযোগটি তাঁর মনে লেগেছে। তিনি গেলেন কোহিনুর প্রেসের মালিক, পরবর্তীতে দৈনিক আজাদী’র প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের কাছে। সৎ উদার এবং পরোপকারী আবদুল খালেক মন দিয়ে শুনলেন ওহীদুল আলমের মনের যাতনা। তিনিই পরামর্শ দিলেন স্কুলের একটি পাঠ্য বই রচনা করে যাতে তাঁর হাতে দেন। সে সময় ব্যক্তি উদ্যোগে পাঠ্য বই রচনার সুযোগ ছিল। শিক্ষক ওহীদুল আলম ‘মুকুলিকা’ নামে স্কুলের একটি পাঠ্যবই লিখে প্রথমে সাহিত্যিক আবুল ফজলকে দেখালেন। তিনি বইয়ের বিষয়বস্তু দেখে প্রশংসা করলেন। তারপর ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের হাতে তা হস্তান্তর করলেন। এখানে বলাই বাহুল্য, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক গুণীজনদের যেমন সমাদর করতেন তেমনি তাদের আপদে–বিপদে আর্থিক সহায়তাও দিতেন। শহরের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ নানা সংকটে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সহযোগিতা পেয়েছেন। ওহীদুল আলমের বই তাঁর এত পছন্দ হয়েছিল যে তিনি বইয়ের লেখক স্বত্ব:
দিতে গিয়ে একখন্ড জমি কেনার পুরো টাকাই দিয়ে দিয়েছিলেন। ওহীদুল আলম তাঁর ভাইপো আনোয়ারুল আলমকে সাথে নিয়ে টাকার বান্ডিলগুলো বাসায় এনে গুনতে গুনতে একপ্রকার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মূলত সাহিত্যিক আবুল ফজলের পরামর্শে ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক শিক্ষক ওহীদুল আলমের স্বপ্নপূরণে এমন সম্মানি তাঁকে দিয়েছিলেন যাতে কাজীর দেউরী দ্বিতীয় গলির জমিটি কিনতে সহজ হয়।
এক খন্ড জমি কিনে ওহীদুল আলম টিনশেডের ঘর করে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি লেখালেখিতে গভীর মনোনিবেশ করলেন। সাথে সাথে বাড়তে থাকে সংসারের পরিধি। চারকন্যা–চারপুত্রের ভরা সংসারে স্ত্রী জরিনা খানমের সহযোগিতায় একপ্রকার নির্বিঘ্নে জীবন অতিবাহিত করেছেন। আলম পরিবারে তিনিই তুলি ও তালের চর্চা শুরু করেছিলেন। ভোরের সূর্য ওঠার সাথে সাথে তাঁর সুমধুর কণ্ঠে পবিত্র কোরানের তেলওয়াত এলাকার অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতেন। তিনি যেমন ধর্মপরায়ন তেমনি সংস্কৃতিমনস্ক উদার মানুষ ছিলেন।
অবসর জীবনে ওহীদুল আলম ‘দেশকাল’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৯৯৮ সালের ২৪ জানুয়ারি রমজানের শুভ্র সকালে তিনি এলেন আমার বাসায়। ভোরে কলিং বেল পেয়েই বুঝতে পেরেছি নানা এসেছেন। দরজা খুলতেই সাহাদাৎ আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন ‘নাতি এবার একশ নিয়েছি’। অর্থাৎ তিনি শতবর্ষ পূরণ করবেন। বাড়ী যাওয়ার প্রস্তুতি হিসাবে পেনসনের টাকাগুলো নাতনীর ঈদের কাপড় কিনতে ঘরে রেখে শুধুমাত্র আসা–যাওয়ার বাস ভাড়া নিয়ে কাজীর দেউড়ী ছেড়েছিলেন ওহীদুল আলম। বলেছিলেন, আমার তেমন খরচ লাগেনা। তবে শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে আমি রীতিমত ‘হরলিক্স’ কিনে চায়ের সাথে পান করি। নিজের পেনশনের টাকা ও বই বিক্রির কিছু সম্মানি পেলে আমার জীবনটাতে তেমন টানাটানি হয়না। আমি কিছু টাকা দিতে চাইলেও তিনি তা নিলেন না। চকবাজার থেকে বাসে ওঠে চলে গেলেন ফতেয়াবাদ। মা–বাবা ও ভাইদের কবর জেয়ারত করে পৈতিৃক বাড়িতে যাওয়ার পথে টেক্সির আঘাতে তিনি আহত হন। টেক্সি চালক তাঁকে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। বাড়ির সবাইকে বললেন, টেক্সি চালকের কোন দোষ নেই, আমার ভুলেই দুর্ঘটনা, ভাইপো আনোয়ারুল আলম বাড়িতেই ছিলেন। একই টেক্সিতে করে তিনি ছোট চাচাকে নিয়ে শহরে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করান।
তাঁর আহত হওয়ার ব্যাপারটি কেউ তেমন গুরুত্ব না দিয়ে একপ্রকার গাছাড়া ভাব করেছিলেন। ভেতরে রক্তক্ষরণ দৃশ্যমান না হওয়ায় তাঁর সেজপুত্র, পুত্রবধূসহ কিছু আত্মীয়–স্বজন হাসপাতালে এসে বাসায় ফিরে যান। বিকালে নাতি সৈয়দ কামরুল হাবীব নানার দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান। সে সময় একাকী মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাছিলেন ফতেয়াবাদের সেই অদম্য ওহীদুল আলম। নাতিকে কাছে পেয়ে ‘পানি পানি’ বলে মৃদুস্বরে আওয়াজ দিলেন। কামরুল দ্রুত নার্সের রুম থেকে এক গ্লাস পানি এনে দ্রুত কিছু পানি পান করালেন। তা মুখে নিয়েই স্বপ্নে ভরা চোখ দুটো বন্ধ করলেন তিনি। চিরদিনের জন্য নিভে গেল শহরে চলে গেলেন নীরবেই প্রদীপটি। ১৯১১ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেয়া প্রকৃতির এই সন্তান ১৯৯৮ সালের ২৪ জানুয়ারি পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি দৈনিক আজাদী ও দৈনিক পূর্বকোণে বিভিন্ন কলাম বিরতীহীনভাবে লিখেছেন।
প্রকৃতির কি অদ্ভূত খেয়াল। পিতা মৌলভী নছিহউদ্দিন দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে যে স্থানে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ওহীদুল আলম ঠিক সেস্থানে চলন্ত টেক্সির আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান। ‘মুকুলিকা’ বইয়ের স্বত্ব: বিক্রি করে যে ভাইপোকে সাথে নিয়ে টাকার বান্ডিল ঘরে এনে গুনতে বসেছিলেন। সেই ভাইপো আনুয়ারুল আলমই তাঁকে টেকসিতে করে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। যে কন্যার আবদার মেটাতে কাজীর দেউড়িতে জমি কিনেছিলেন তাঁর তৃতীয় ছেলে সৈয়দ কামরুল হাবীবের হাত থেকে পানি পান করেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পুত্র–কন্যাবিহীন হাসপাতালের বিছানায় একাকী ছটফট করতে করতেই ফতেয়াবাদের সেই দুরন্ত পথিক নীরবে প্রস্থান করলেন।
লেখক : দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ–এর সম্পাদক