বহুল আলোচিত মেজর (অবসরপ্রাপ্ত ) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া মামলার ৬ আসামীকে যাবজ্জীবন সাজা এবং বাকী ৭ আসামিকে খালাস দেয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার জনাকীর্ণ আদালতে এই চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণা করেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত এবং পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন। রায়ে সাজাপ্রাপ্ত ৮ জন আসামীকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডও প্রদান করা হয়েছে। মামলার অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত আসামীরা হলেন- কনস্টেবল সাফানুর করিম, আব্দুল্লাব্দুহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, কামাল হোসেন আজাদ ও মো. আবদুল্লাহ আল মাহমুদ।
এর আগে জেলা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল বেলা ২ টা ২৫ মিনিটে এজলাসে ওঠে ৩০০ পৃষ্ঠার রায় পাঠ শুরু করেন। দীর্ঘ প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে রায় পাঠকালে বিচারক বলেন, আসামীদের বিরুদ্ধে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাদের কৃত অপরাধ অনুযায়ী সাজা দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, ‘আমি মেজর সিনহা হত্যা মামলাটির বিভিন্ন ইস্যু খুঁটিনাটি খোঁজার চেষ্টা করেছি। এতে প্রমাণিত হয় সিনহা হত্যা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’ রায় ঘোষণার আগে মামলার ১৫ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তায় কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। এসময় মামলার বাদী নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, বাদী পক্ষের আইনজীবী ও আসামী পক্ষের আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। আসামীদের স্বজনেরাও রায় শুনতে আদালত এলাকায় আসেন।
আদালতে রায় ঘোষণা করার পর আসামীর কাঠগড়ায় টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ দাশ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে নির্বিকার দেখা যায়। তবে চিৎকার করে কান্নাকাটি করেন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মোহাম্মদ আয়াছ ও নিজাম উদ্দিন।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাতে টেকনাফের মারিশবুনিয়া পাহাড়ে ভিডিওচিত্র ধারণ করে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কঙবাজারের হিমছড়ি এলাকার নীলিমা রিসোর্টে ফেরার পথে শামলাপুর এপিবিএন এর তল্লাশি চৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মো: রাশেদ খান। এসময় তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে আটক করে পুলিশ। এরপর সিনহা যেখানে ছিলেন সেই নীলিমা রিসোর্টে ঢুকে তার ভিডিও দলের দুই সদস্য শিপ্রা দেবনাথ ও তাহসিন রিফাত নুরকে আটক করা হয়। পরে তাহসিনকে ছেড়ে দিলেও শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। এই দুজন পরে জামিনে মুক্তি পান।
সিনহা হত্যার ঘটনায় মোট চারটি মামলা হয়। ঘটনার পরপরই পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা করে। এর মধ্যে দুটি মামলা হয় টেকনাফ থানায়, একটি রামু থানায়। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদি হয়ে ওই বছরের ৫ অগাস্ট কঙবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। মামলায় বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে ১ নম্বর এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ২ নম্বর আসামী করা হয়। মামলার পর ওসি প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্য পরদিন ৬ আগস্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
এ ঘটনায় দায়ের করা চারটি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। এরপর মামলায় তদন্তে আসা আরো ৬ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব। ১৩ আসামীকে নানা মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর সিনহা হত্যায় ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। আসামীদের মধ্যে ওসি প্রদীপ, নন্দদুলাল ও সাগর দেব ছাড়া বাকী ১২ আসামী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন।
অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। গত বছরের ২৭ জুন ১৫ আসামীর বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারের জন্য অভিযোগ গঠন করা হয়। এরপর গত ২৩ আগস্ট থেকে কঙবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ এবং জেরা শুরু হয়ে গত ১ ডিসেম্বর শেষ হয়। সর্বশেষ আদালত ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি চারদিনের উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে গতকাল ৩১ জানুয়ারি বহুল প্রত্যাশিত রায় ঘোষণা করা হলো।
এদিকে গতকাল এ রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে উৎসুক মানুষের দৃষ্টি ছিল মিডিয়ার দিকে। এজন্য গতকাল দিনভর রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল ছিল অন্যদিনের তুলনায় অনেক কম।
যে হত্যা নাড়িয়ে দিয়েছিল পুরো জেলার পুলিশ প্রশাসনকে
সিনহা হত্যার ঘটনাটি পুরো জেলা পুলিশকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল। সিনহাকে গুলি করে হত্যার পর তার কাছ থেকে ‘মাদক’ উদ্ধারের গল্প প্রচারের পর পুলিশের বিরুদ্ধে সর্বত্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে ঘটনার ২ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জেলার সকল পুলিশ সদস্যকে অন্যত্র বদলী করে দেয়া হয়।
সিনহা হত্যা মামলায় কয়েকজন পুলিশ সদস্যের গ্রেফতারের পর টেকনাফ থানা পুলিশ, সদর থানা পুলিশ, উখিয়া ও চকরিয়া থানা পুলিশের বিরুদ্ধেও ইয়াবা ব্যবসায়ী অপবাদে ‘ক্রসফায়ার’ এর নামে নিরীহ মানুষকে হত্যার অভিযোগে আদালতে কয়েক ডজন মামলার আবেদন হয়। মামলার আবেদনে পুলিশের কয়েকশত সদস্যকে আসামী করা হয়। এসব ঘটনায় পুলিশের কার্যক্রমেও দেখা দেয় চরম স্থবিরতা। এই অবস্থায় জেলা পুলিশকে ঢেলে সাজানোর লক্ষে নজিরবিহীন রদবদলের মাধ্যমে জেলায় কর্মরত প্রায় সকল পুলিশ সদস্যকে পর্যায়ক্রমে অন্যত্র বদলী করে দেয়া হয়েছে।