‘ওসি প্রদীপ আমার স্বামীকে ৭ মাস আটকে রেখে নির্যাতন চালায়’

মেজর (অব.) সিনহা হত্যা মামলায় আদালতে স্বাক্ষী ছেনোয়ারা

কক্সবাজার প্রতিনিধি | মঙ্গলবার , ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১০:৩১ অপরাহ্ণ

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার পঞ্চদশতম সাক্ষী ছেনুয়ারা বেগম আদালতে সাক্ষ্যদানকালে বলেছেন, “টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ আমার স্বামী আব্দুল জলিলকে আটক করে থানায় নিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় তলায় একটি টর্চার রুমে সাত মাস বন্দী রেখে নির্যাতন চালায়। পরে ওসি প্রদীপ তার দুই জন কন্সটেবল সাগর দেব ও রুবেল শর্মাকে দিয়ে আমার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এই টাকা দেয়ার পরও ওসি প্রদীপ আমার স্বামীকে ক্রসফায়ার দিয়ে হত্যা করে।”

আজ মঙ্গলবার (২৮ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে সিনহা হত্যা মামলার চতুর্থ দফায় সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম দিন মামলার স্বাক্ষী টেকনাফের গৃহবধূ ছেনুয়ারা বেগমের সাক্ষ্যগ্রহণকালে আদালতে মামলার আসামীরাও উপস্থিত ছিলেন।

ছেনুয়ারা বেগম তার সাক্ষ্যপ্রদানকালে আদালতের কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান প্রদীপকে লক্ষ্য করে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। এসময় ওসি প্রদীপকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। ছেনুয়ারা বেগম আদালতে ওসি প্রদীপের নির্যাতনের বর্ণনা দানকালে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আদালতে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে পঞ্চদশতম স্বাক্ষী হিসেবে টেকনাফের হ্নীলার বাসিন্দা গৃহবধূ ছেনুয়ারা বেগমের জবানবন্দী গ্রহণের মধ্য দিয়ে চতুর্থ দফায় প্রথম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়।

ওসি প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানায় কর্মরত থাকাকালীন তার (ছেনুয়ারা) স্বামীকে তুলে নিয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করে বলে দাবি করেন তিনি।

আদালতে মামলার অপর স্বাক্ষী টেকনাফ সদর ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা হাম জালাল তার ওপর ওসি প্রদীপের নানা নির্যাতনের বর্ণনা দেন।

এই দুইজন ছাড়াও আলী আকবর নামের আরো একজন স্বাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।

এ নিয়ে মঙ্গলবার সিনহা হত্যা মামলায় আদালতে তিনজন স্বাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে।

তবে স্বাক্ষী হাম জালালকে ওসি প্রদীপসহ তিন আসামীর আইনজীবীরা জেরা করতে পারেননি। তারা আগামীকাল বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) চতুর্থ দফায় সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ দিন স্বাক্ষীদের জেরা সম্পন্ন করবেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম এবং বাদীপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর মঙ্গলবার সিনহা হত্যা মামলার চতুর্থ দফায় সাক্ষ্যগ্রহণের প্রথম দিন আদালতের কার্যক্রম শেষে সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা জানান।

মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। চলে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত।

অপরদিকে, ওসি প্রদীপের পক্ষের আইনজীবী এডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে অভিযোগ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা সিনহা হত্যা মামলাকে অতি দ্রুত শেষ করতে গিয়ে আসামীদের মতো বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করতে পারেন।

এর আগে গত ২৩ আগস্ট থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রথম দফায় টানা তিন দিনে মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস এবং প্রত্যক্ষদর্শী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়েছিল।

এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় টানা চার দিনে আরো চারজন স্বাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও আসামীপক্ষের আইনজীবীদের জেরা সম্পন্ন হয়।

গত ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় দফায় টানা ৩ দিনে আরো আটজন স্বাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। এ নিয়ে মামলার ১৭ জন স্বাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হলো। মামলায় মোট ৮৩ জন স্বাক্ষী রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৩১ জুলাই ঈদুল আযহার আগের রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের বাহারছড়ার এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলীতে খুন হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ খান।

এ ঘটনার ৫ দিন পর ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামী এবং টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস সহ নয় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান র‌্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।

চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্তের পর গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এ আলোচিত মামলার ১৫ আসামী হলো টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, তার দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

গত ২৭ জুন ফৌজদারী দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/ ১১৪/১২০-খ/ ৩৪ ধারায় ১৫ আসামীর বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারের জন্য অভিযোগ গঠন করা হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির ভাগ্য পরিবর্তনে শেখ হাসিনা নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন
পরবর্তী নিবন্ধটাকায় যাবে না লেখা, দেয়া যাবে না সিল-স্বাক্ষর