ওরা স্কুলপড়ুয়া, সবাই পাবজি আসক্ত

ভয়ংকর তথ্য উদঘাটন যেভাবে ।। আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও উদ্বিগ্ন অভিভাবক ।। ভাড়ায়ও মিলছে খেলার মোবাইল

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৩ এপ্রিল, ২০২২ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

পাথরঘাটা সেন্ট প্লাসিড স্কুলের অদূরে ছোট একটি ফ্লেক্সিলোডের দোকান রয়েছে। প্রায় সময়ই দোকানটিতে ভিড় থাকে কাস্টমারের। তবে অধিকাংশ কাস্টমারের বয়স নয় থেকে বারো বছর। একদিন পঞ্চম শ্রেণীর একজন ছাত্র ওই দোকানে আসে এবং একটি বিকাশ নম্বর দিয়ে তাতে ২৯ হাজার টাকা বিকাশ করতে বলে। দোকানদার ছেলেটির মাকে বিষয়টি জানান। একসময় সেটি কোতোয়ালী থানা পুলিশের কানে যায়।

কোতোয়ালীর সাবেক ওসি বর্তমানে পিবিআই কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর নেজাম উদ্দিনের নির্দেশে একটি টিম ওই দোকানদারকে ধরে আনে। থানায় আনার পর দেখা যায় তার ফোনে একের পর এক কল আসছে। ওসির নির্দেশে দোকানদার কল ধরে। সবাই বিকাশের ক্রেতা। পুলিশের নির্দেশ মতো দোকানদার তাদের পাথরঘাটা তার দোকানের সামনে দাঁড়াতে বলে। পরে পুলিশ সেখানে গিয়ে একে একে ১৭ জনকে নিয়ে আসে। তাদের মধ্যে সবাই চতুর্থ শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত। প্রত্যেকেই ফ্রি ফায়ার এবং পাবজি গেম খেলায় আসক্ত। পরে পুলিশ তাদের অভিভাবকের জিম্মায় দিয়ে দেয় এবং দোকানদার এ বয়সের কারও মোবাইলে টাকা দেবে না-এই মুচলেকায় ছাড় পায়।

গতকাল শুক্রবার পাবজি ও ফ্রি ফায়ার গেমে আসক্তির বিষয়ে কোতোয়ালী থানায় কর্মরত এক পুলিশ অফিসার আজাদীকে ভয়ংকর এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, ইয়াবার নেশার চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠছে পাবজি, ফ্রি ফায়ারের মতো অনলাইন গেমের নেশা।

প্রসঙ্গত, গত ২০ এপ্রিল বুধবার দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজি গেম বন্ধের আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে গেম পরিচালনাকারী সিঙ্গাপুরের কোম্পানি প্রক্সিমা বেটা প্রাইভেট লিমিটেডের করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন হাই কোর্ট। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাই কোর্ট বেঞ্চ বুধবার তা খারিজ করে আদেশ দেন। এর ফলে পাবজি-ফ্রি ফায়ারসহ অনলাইনের ‘বিপজ্জনক’ সব গেম বন্ধে হাই কোর্টের আগের আদেশই বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। গত বছরের ২৪ জুন মানবাধিকার সংগঠন ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে পাবজি-ফ্রি ফায়ারসহ ক্ষতিকর অনলাইন গেম বন্ধের আদেশ চেয়ে রিট করা হয়। গত বছরের ১৬ আগস্ট দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজি, ফ্রি ফায়ারসহ ‘বিপজ্জনক’ সব গেম তিন মাসের জন্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাই কোর্ট। পরে ওই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। এর মধ্যে রিটে বিবাদী হিসেবে পক্ষভুক্ত হয়ে প্রক্সিমা বেটা এ আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আদালতে আবেদন জানায়। রিটকারীর আইনজীবী হুমায়ন কবির পল্লব বলেন, ‘আদালতের এ আদেশের ফলে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে পাবজি নিষিদ্ধই থাকবে।’ কিন্তু হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ‘ফ্রি ফায়ার ও পাবজি’ গেমের নেশায় মত্ত কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে ভয়ঙ্কর আসক্তি তৈরি করছে। ইতোমধ্যে পাবজি-ফ্রি ফায়ার গেমসহ লাইকি, বিগোর মতো ভিডিও স্ট্রিমিং অ্যাপ বন্ধের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও এ ভয়ংকর নেশার গেম এখন অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকমহল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে তরুণদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ফ্রি ফায়ার, পাবজি, ক্লাস অব ক্ল্যানস, মাইন ক্র্যাফট, কাউন্টার স্ট্রাইক গ্লোবাল অফেন্স, কল অব ডিউটি ওয়ার জোনের মতো সহিংসতাপূর্ণ গেম। এ সব গেমে অস্ত্রের ব্যবহার, মেরে ফেলা ও বোমাবাজি রয়েছে। সহিংসতাপূর্ণ গেম মানুষের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তা নিয়ে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের দুটি গবেষণায় দু’ধরনের ফলাফল দেখা যায়। একটিতে দেখা যায়, যাদের মধ্যে সহিংসতাপূর্ণ মনোভাব থাকে, তারা এ সব গেম খেলে সহিংস আচরণ করতে পারে। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, এ ধরনের ভিডিও গেম সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সহিংস আচরণ উস্‌কে দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও অনলাইন গেম আসক্তিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে নগরীর পাথরঘাটা ছাড়াও গোয়ালপাড়া, রেল স্টেশন, হাজারী গলি, সিআরবি, চেরাগী পাহাড়, জিইসির মোড়, মুরাদপুর, কমার্স কলেজ রোড, মতিয়ার পোল, কালামিয়া বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ভাড়ায় মিলছে পাবজি, ফ্রি ফায়ার গেমস খেলার মোবাইল। এ জন্য যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ভিডিও গেমসের দোকান। এ সব দোকানে ঘণ্টা হিসাবে মোবাইল ভাড়া দেয়া হয়। প্রতি ঘণ্টায় গেমসের মোবাইল ভাড়া দেয়া হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়। আর প্রতি গেমে ৩৫-৪০ টাকা। প্রত্যেক দোকানে ২৫-৩০টি মোবাইল রয়েছে। ফ্রি ফায়ার খেলার জন্য এ সব মোবাইল ঘণ্টা অথবা প্রতি গেম হিসাবে ভাড়া দেয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থী খেলার টাকা জোগাড় করতে না পেরে বাসা থেকে টাকা চুরি করে। টিফিন কিংবা জামা-কাপড় কেনার কথা বলে এ টাকা দিয়ে ফ্রি ফায়ার গেমস খেলে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাহিদ বলেন, আমার সন্তান ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। এলাকায় গড়ে উঠেছে ফ্রি ফায়ার গেমসের দোকান। সেখানে সারাক্ষণ টাকা দিয়ে গেমস খেলে। বাসার আলমারি থেকে টাকা নিয়ে গেমসের দোকানে যায়। দোকানদারকে নিষেধ করলে বলে আমি কি আপনার সন্তানকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছি। চারদিকে গেমসের দোকানের ছড়াছড়ি। ছেলেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। দোকানগুলো বন্ধ থাকলে আমরা অভিভাবকরা উপকৃত হতাম। প্রয়োজনে আপনারা রাতে এসে দেখতে পারেন কিভাবে বাচ্চারা গেমস খেলে সময় নষ্ট করছে।

নগরীর জামাল খান এলাকার নাসরিন বেগম আজাদীকে বলেন, আবেদন থাকবে আদালত যেন পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে এসব ক্ষতিকর গেম স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন।

সম্প্রতি ভারতীয় গণমাধ্যমে এই গেমাসক্তি নিয়ে একটি ভয়ংকর ঘটনার সংবাদ উঠে এসেছে। পাবজি গেম খেলতে গিয়ে বাবাকে পথে বসিয়েছে এক কিশোর। ছেলের কাছে বাবার তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য থাকায় এই দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন বাবা। ১৭ বছর বয়সী ভারতের পাঞ্জাবের ওই কিশোর, জনপ্রিয় গেমটি খেলার সময় বিভিন্ন পেড অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে এবং গেম আপগ্রেড করতে ১৬ লাখ টাকা খরচ করেছে। ওই কিশোর তার মায়ের ফোন থেকে পাবজি খেলতো। ছেলের হাতে দীর্ঘসময় ফোন দেখে মা বকাবকি করলে, পড়াশোনার জন্য তাকে দীর্ঘসময় মোবাইল ব্যবহার করতে হচ্ছে বলে সে জানাতো। যদিও সে ওই সময় তার বন্ধুদের সাথে পাবজি খেলতো। অ্যাপ্লিকেশন কেনার পাশাপাশি, গেমটি খেলতে গিয়ে সে টিমমেটদের জন্য আপগ্রেডও কিনেছিল বলে জানা গেছে। যদিও সে কোনোদিন বাবা-মাকে গেম খেলার জন্য অর্থ খরচের কথা জানায়নি। এমনকি ফোনে ব্যাংক থেকে মেসেজ এলে সে সেগুলো ডিলিট করে দিত। তবে ব্যাংকের বই আপডেট করার পর তার বাবা-মা ১৬ লাখ টাকার হিসেব বুঝতে পারেন। ওই কিশোরের বাবা একজন সরকারি চাকুরিজীবী। তিনি ছেলের ভবিষ্যৎ ও চিকিৎসার জন্য ওই টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন। কিশোর যখন পাবজি খেলতো তখন তার বাবার পোস্টিং অন্য জায়গায় ছিল। জানাজানি হওয়ার পর ওই কিশোরের পরিবার পুলিশের কাছে সাহায্য চাইলেও, পুলিশ তাদের কোনো সাহায্য করতে পারেনি। কারণ গেম কোম্পানি ভুলভাবে কোনো অর্থ নেয়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাবেক এমপি বদির হাতে মারধরের শিকার পৌর আ.লীগের দুই নেতা
পরবর্তী নিবন্ধপরিবেশের ক্ষতিকারকরা দেশ ও মানুষের শত্রু : তথ্যমন্ত্রী