স্বজনরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো তাদের প্রিয়জন পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি কখন বের হবে আন্তর্জাতিক আগমন গেইট দিয়ে। এসময় সাথে থাকতো এক বা একাধিক বড় বড় মালের গাইড (ব্যাগ)। যেখানে থাকতো মা স্ত্রী সন্তানদের জন্য প্রসাধনী। হয়তো পিতার জন্য নিয়ে আসতো একটা এন্ড্রয়েড মোবাইল সেট। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এ বুঝি তাদের প্রিয়জন বিমানবন্দরের গেইট দিয়ে প্রবাসী যাত্রীদের মালবাহী ট্রলি নিয়ে বের হচ্ছে। কতক্ষণে ঘুচবে দীর্ঘদিন না দেখার প্রতীক্ষা।
প্রতিদিন ঢাকা–চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে গেলে এ দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। এ এক অন্যরকম অপেক্ষা। এবার আর আন্তর্জাতিক আগমন গেইটে অপেক্ষা নয়, স্বজনরা অপেক্ষায় আছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো গেইটে। অন্যবার আত্মীয়–স্বজনরা যেখানে প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস নিয়ে প্রবাস ফেরত প্রিয়জনকে নিতে আসতো, এবার তাদের নিতে এসেছে লাশবাহী অ্যম্বুল্যান্স নিয়ে।
শনিবার রাত ৯টা। বিমানবন্দরের কার্গো গেইটে একজন কর্মকর্তা এসে নিহতদের নাম ধরে ডাকছে স্বজনদের। যাতে বৈধ অভিভাবক লাশটি বুঝে নিতে পারে। গত ৮ অক্টোবর ওমানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রামের আটজন প্রবাসী নিহত হয়।
এরমধ্যে সাতজনই চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বাসিন্দা। অন্যজনের বাড়ি রাউজান উপজেলায়। ১০ দিন পর শনিবার এল প্রবাসী এ রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের লাশ। এ ঘটনায় সন্দ্বীপের আকাশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এ দ্বীপের বাসিন্দাদের মধ্যে যারা উপার্জনক্ষম তাদের বিশাল অংশ প্রবাসে। বলা যায় সন্দ্বীপের অর্থনৈতিক অবস্থা ও অবকাঠামো উন্নয়ন পুরোপুরি প্রবাসীদের হাড়ভাঙা খাটুনির অর্থেই গড়া। সেখানে এ মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক ঘটনায় সন্দ্বীপবাসীর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
রাত ৯টা ৫ মিনিট। একে একে বিমানবন্দরের কার্গো গেইট দিয়ে বের হয়ে আসে ৮টি লাশবাহী কফিন। আত্মীয়স্বজনসহ শোকাহত সন্দ্বীপবাসী মুহূর্তে শোককে শক্তিতে পরিণত করে কফিনগুলো বুঝে নিচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে সবাইকে দেখা যায় কফিনগুলো কাঁধে তুলে নিতে। পরম যত্নে উঠিয়ে দেয় লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্সে। রাত ১০টা ৪০ মিনিট। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাশবাহী সাতটি অ্যাম্বুল্যান্স একসাথে সাইরেন বাজিয়ে কুমিরা ঘাটের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিহতদের করুণ পারিবারিক অবস্থা। বেশিরভাগই টিনের কাচা ঘর। পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তির এমন মৃত্যুতে অনাগত দিনে তাদের কি হবে তারা কেউ জানে না। একদিকে অসচ্ছল পারিবারিক অবস্থা। অন্যদিকে নিহতরা রেখে যায় ছোট ছোট সন্তান। বেশিরভাগেরই বয়স এক থেকে দুই বছর। আবার নিহতদের কেউ কেউ সরাসরি দেখেনি তার সন্তানের প্রিয় মুখখানি পর্যন্ত। নিহত সারিকাইতের বাসিন্দা রকিকে নিজের হাতে সন্তানকে আদর করতে না পারার দুঃখ নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে এ পৃথিবী থেকে। আরেক হতভাগা পিতা আমিন সওদাগর। কিছুদিনের মধ্যে এসে বড় মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নিয়তির কাছে তাকেও হেরে যেতে হয়। বাবলুর দুই ও চার বছর বয়সী দুটি ফুটফুটে ছেলে–মেয়ে। বাবা নামক বটবৃক্ষকে যে তারা এ বয়সে হারিয়ে ফেলেছে এটি উপলব্ধি করাও তাদের পক্ষ সম্ভব নয়।
রাতেই লাশবাহী অ্যাম্বুল্যান্স থাকবে কুমিরা ঘাটে। রোববার সকাল ৭টায় কুমিরা ঘাট থেকে স্পিডবোট করে নেয়া হবে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে। সেখান থেকে উপজেলার এনাম নাহার মোড়ের কাছেই পূর্ব সন্দ্বীপ হাইস্কুল মাঠে সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হবে নামাজে জানাজা। এরপর নিজ নিজ এলাকায় আরেকটি জানাজার নামাজ শেষে অনন্তকালের যাত্রা শুরু হবে সন্দ্বীপ তথা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি এই সাত রেমিট্যান্স যোদ্ধার।