ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ বেশ কয়েক দফা পরিশোধের মেয়াদ নবায়ন করা হয়। এরপর আবেদনক্রমে ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। অথচ ঋণের বিপরীতে কোন স্থাবর সম্পত্তি দায়বদ্ধ নেই। মূলত পারসোনাল গ্যারান্টিতে উক্ত ঋণ বিতরণ করা হয়। সাউথইস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে নেওয়া ১২ কোটি ৩৮ লাখ ৯০ হাজার ৯২৪ টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ঋণ গ্রহীতা হচ্ছেন ওয়ান ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক সাঈদ হোসাইন চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী। ওয়ান ব্যাংকে সাঈদ হোসাইন চৌধুরী বিপুল পরিমাণ (৮৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা) শেয়ার ধারণ করছেন। বলা যায়, ঋণ পরিশোধে তিনি সামর্থবান। কিন্তু আইন আদালতের পদ্ধতিগত অপব্যহারের সুযোগ নিয়ে তিনি খেলাপি ঋণ পরিশোধ করছেন না। ঋণ আদায় সংক্রান্ত চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতের একটি পর্যালোচনায় উঠে আসে এ তথ্য। এদিকে গতকাল সাঈদ হোসাইন চৌধুরী ও তার স্ত্রী ফারজানা চৌধুরীকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালতটির বিচারক মুজাহিদুর রহমান। সাউথইস্ট ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারক এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। পর্যালোচনায় আদালত বলেন, সাঈদ হোসাইন চৌধুরী ও তার স্ত্রীকে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি হিসেবে প্রতিয়মান হয়েছে। নালিশি ঋণের বিপরীতে কোন স্থাবর সম্পত্তি বন্ধক না থাকায় বিবাদীরা দেশত্যাগ করলে সম্ভাব্য ডিক্রি পরিতুষ্ট করা সম্ভব হবে না। তাই বিবাদীদের দেশত্যাগের অধিকার বিচারিক সিদ্ধান্তের অধীন থাকা সমীচীন।
অর্থঋণ আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম আজাদীকে বলেন, আদালতের অনুমতি ব্যতীত দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। বিবাদীরা যেন আদালতের অনুমতি ব্যতীত দেশত্যাগ করতে না পারেন তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশের কপি বিশেষ পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন), বিশেষ শাখা, বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা বরাবরে প্রেরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক।
আদালতসূত্র জানায়, ২০০৯ সালে বিতরণ করা ঋণ খেলাপিতে পরিণত হওয়ার পর উক্ত ঋণ আদায়ের লক্ষে ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর ব্যাংকের পক্ষ থেকে সাঈদ হোসাইন চৌধুরী ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা দায়ের করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৬ আগস্ট বিবাদীরা লিখিত বর্ণনা দাখিল করেন। এতে বাদী ব্যাংকের কাছে খেলাপি ঋণের দায় থাকার কথা স্বীকার করেছেন বিবাদীরা। গতকাল শুনানির পর্যালোচনায় আদালত বলেছেন, নালিশি ঋণ বিবাদীরা উপভোগ করেছিলেন ২০০৯ সালে। বেশ কয়েক দফা পরিশোধের মেয়াদ নবায়ন করার পর ২০১৯ সালে নালিশি ঋণ বিবাদীর আবেদনক্রমে পুনঃতপশীল করা হয়। পর্যালোচনায় বলা হয়, বিবাদী ওয়ান ব্যাংকের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ও তার স্ত্রী ওয়ান ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ (৮৪,৯০,০০,০০০/-টাকার) শেয়ার ধারণ করছেন। এতে প্রতীয়মান হয় তারা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে যথেষ্ট সামর্থ্যবান। মূলত আইন আদালতের পদ্ধতিগত অপব্যবহারের সুযোগ নিয়ে খেলাপি ঋণ পরিশোধ করছেন না।
আদালতের পর্যালোচনায় আরো উঠে আসে, বিবাদীরা ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি। কোন ঋণ খেলাপি ব্যক্তি ব্যাংকিং কোম্পানী আইনের বিধান মোতাবেক কোন ব্যাংকের ডিরেক্টর পদে আসীন থাকতে পারেন না। অত্যন্ত হতাশাজনক সত্য হচ্ছে সাঈদ হোসাইন চৌধুরী এই আদালতের রেকর্ড অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের ঋণ খেলাপি গ্রাহক হওয়া সত্বেও তিনি ওয়ান ব্যাংকের ডিরেক্টর পদে বহাল আছেন। একজন ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিকে ব্যাংকের ডিরেক্টর পদে আসীন রেখে দেশের ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের লাগাম টেনে ধরা অসম্ভব। আদালতের পর্যালোচনায় আরো উঠে আসে, সাঈদ হোসাইন চৌধুরীকে ওয়ান ব্যাংকের ডিরেক্টর পদ থেকে অপসারণ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর আদেশের কপি প্রেরণ করা হয়েছিল। ব্যাংকিং কোম্পানী আইন লঙ্ঘন করে সাঈদ হোসাইন চৌধুরীর ওয়ান ব্যাংকের ডিরেক্টর পদ বহাল থাকায় ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপ সমূহের কার্যকরিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নিষ্ক্রীয় অবস্থানের কারণে দেশে ঋণ খেলাপি সংস্কৃতি মহামারী আকার ধারণ করেছে। কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের অর্থ ব্যাংক থেকে চাহিদা মোতাবেক তুলতে না পেরে গ্রাহকদের মাঝে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে বলেও পর্যালোচনায় উল্লেখ করেন বিচারক।