আবদুল জব্বারের বলী খেলার আসর প্রতিবছর বসে ১২ বৈশাখ। ১৯০৯ সালের ২৫ এপ্রিল বদরপাতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার লালদিঘির মাঠে এই বলী খেলার আয়োজন করেন। তাঁর নামানুসারে এটি জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
বলী খেলা নিয়ে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘বলী’ সিনেমা। চলচ্চিত্রের পরিচালক বাঁশখালীর সন্তান ইকবাল হোসাইন চৌধুরী। প্রযোজক পিপলু আর খান, নাসির উদ্দিন খান –এঁরা সবাই চট্টগ্রামের সন্তান। বলা যায়, চট্টগ্রামই এই সিনেমার অনুপ্রেরণা। বলিউডের ‘সুলতান’ সিনেমাটিও এক কুস্তিগীরের জীবনকাহিনি। যেটার মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন সালমান খান। পরিচালনা করেছেন, আলী আব্বাস জাফর। আমির খান অভিনীত ‘দঙ্গল’ সিনেমাটিও মহাবীর সিংকে নিয়ে। এটি পরিচালনা করেন নিতেশ তেওয়ারী। পাকিস্তানের ভুলু পাহলোয়ানের অনেকের মনে থাকার কথা। স্বাধীনতা–পূর্ব চট্টগ্রামের নিয়াজ স্টেডিয়ামে (বর্তমানে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম) ভুলু পাহলোয়ানসহ আরো অনেকে শক্তি প্রদর্শন করে গেছেন। স্বাধীনতা–উত্তর তাঁরই উত্তরসূরি নাসের ভুলুসহ আরো অনেকে এই স্টেডিয়ামে কুস্তি খেলে গেছেন।
মূলত সুলতানি আমল থেকে সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে চট্টগ্রামে কুস্তির চর্চা হতো। তখন এ অঞ্চলের সেনারা ছিলেন পদাতিক। তাই কুস্তির মধ্য দিয়ে শারীরিক সামর্থ্য ধরে রাখার প্রয়োজন ছিল তাদের। এরপর মল্ল সমপ্রদায়ের মানুষজন গ্রামে গ্রামে বৈশাখ মাসে বলী খেলার আয়োজন করতেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সাংস্কৃতিক কর্মীরা অচিরেই ব্রিটিশ বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে কারণে তাঁদের কর্মকাণ্ডের উপরে ব্রিটিশদের সার্বক্ষণিক নজর ছিল। তাই বিকল্প পন্থা হিসাবে খেলাধুলাকে বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিপ্লবীরা ও তাঁদের সমর্থকরা। আবদুল জব্বারের বলী খেলাও খেলাধুলার আড়ালে ব্রিটিশবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। ব্যবসায়ী জব্বার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ব্যতিক্রমধর্মী এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করলেও, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
একসময় বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও আরাকান অঞ্চল থেকে স্বনামধন্য বলীরা এ খেলায় অংশগ্র নিতেন। চট্টলতত্ত্ববিদ আবদুল হক চৌধুরী ‘বন্দর শহর চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম বলীর দেশ। কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী স্থানের ঊনিশটি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। প্রচণ্ড দৈহিক শক্তির অধিকারী মল্লরা সুঠামদেহী সাহসী পুরুষ এবং তাদের বংশানুক্রমিক পেশা হচ্ছে শারীরিক কসরৎ প্রদর্শন। এই মল্লবীরেরাই ছিলেন বলী খেলার প্রধান আকর্ষণ ও বলী খেলা আয়োজনের মূল প্রেরণা। চট্টগ্রামের বাইশটি মল্ল পরিবার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। আশিয়া গ্রামের আমান শাহ মল্ল, চাতরি গ্রামের চিকন মল্ল, কাতারিয়া গ্রামের চান্দ মল্ল, জিরি গ্রামের ঈদ মল্ল ও নওয়াব মল্ল, পারি গ্রামের হরি মল্ল, পেরলা গ্রামের নানু মল্ল, পটিয়ার হিলাল মল্ল ও গোরাহিত মল্ল, হাইদগাঁওর অলি মল্ল ও মোজাহিদ মল্ল, শোভনদণ্ডীর তোরপাচ মল্ল, কাঞ্চননগরের আদম মল্ল, ঈশ্বরখাইনের গনি মল্ল, সৈয়দপুরের কাসিম মল্ল, পোপাদিয়ার যুগী মল্ল, খিতাপচরের খিতাপ মল্ল, ইমামচরের ইমাম মল্ল, নাইখাইনের বোতাত মল্ল, মাহাতার এয়াছিন মল্ল, হুলাইনের হিম মল্ল, গৈরলার চুয়ান মল্ল।’
বাংলাদেশে বলী খেলাকে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি এনে দিয়েছে লালদিঘি মাঠের জব্বারের বলী খেলা। এ ছাড়াও পটিয়ার তোফায়েল আলী মুন্সীর বলী খেলা, পরির দিঘির বলী খেলা, আমজু মিয়ার বলী খেলা, আনোয়ারার এর্শাদ আলী বলী খেলা, সিআরবির শিরিষতলার সাহাব উদ্দিনের বলী খেলা, সাতকানিয়ার বলী খেলা, রামুর বলী খেলা, কক্সবাজারের ডিসি সাহেবের বলী খেলা অন্যতম।
জব্বারের বলী খেলাকে ঘিরে বসে লালদিঘির আশেপাশে বসে বৈশাখী মেলা। সারাবছর গৃহিণীরা এই মেলার অপেক্ষায় থাকে। ঘর সাজানো থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় পণ্য এই মেলায় পাওয়া যায়। মেলা থেকে বাহারি রঙের খেলনা ও আসবাব আসে। জব্বারের বলী খেলা মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। এটি নির্মল বিনোদন, আর চট্টগ্রামের ঐতিহ্য।