চট্টগ্রাম শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন অধিকাংশ, দীঘি, পুকুর জলাশয় বিলীন হয়ে গেছে। নাম মাত্র অস্থিত্ব রযেছে কয়েকটা দীঘির। তাও হাতে গোণার মতো। তার মধ্যে চট্টগ্রামের কোরবানীগঞ্জ এলাকার বলুয়ারদীঘি হলো দুইশ বছরের পুরনো। ঐতিহ্যের দিক দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এই বলুয়ারদীঘি এলাকাটি নগরের অতি নিকটেই অবস্থিত। আন্দরকিল্লা, টেরীবাজার, নবাবসিরাজউদ্দৌলাহ সড়ক পেরিয়ে দীঘির দেখা মেলে। ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়, সেই সময় বলুয়ারদীঘির পূর্ব অংশের এলাকাটি ছিলো পুরো জঙ্গলাকীর্ণ। এই জঙ্গলাকীর্ণ জায়গাটিতে প্রায় দুইশত বছর আগে মোগল আমলে ঐতিহাসিক বলুয়ারদীঘি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভুলু পোদ্দার ছিলেন ওই এলাকার একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী। প্রায় দুইশত বছর আগে বলুয়ারদীঘির গোড়াপত্তনের মূল অংশীদার ছিলেন জমিদার ভুলু পোদ্দার।
অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে নিজের ব্যবসায়ে প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর কাছে রক্ষিত স্বর্ণের পাত বিক্রি করে চারিদিকে জঙ্গলাকীর্ণ ঝোপ ঝাড়ে ভরপূর জমিটি নিজের করে নেন। কিন্তু বিশাল আকারের জমিটি ছিলো অনাবাদী এবং পুরোপুরি ব্যবহার অনুপযোগী। তাই তিনি মনে মনে চাইছিলেন, জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। তিনি জনকল্যাণমূলক চিন্তা থেকে নিজ জমির ওপর দীঘি খনন করান। তাঁর খননকৃত দীঘিটি সেই দু্ই শ বছর পূর্বেই প্রথমেই “ভুলু পোদ্দার” দীঘি নামে পরিচিতি লাভ করে। একদিকে দীঘি খনন করে জনসেবা বা প্রজাদের সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন। জানা গেছে, তিনি ব্যবসায় সাফল্য লাভের পাশাপাশি জাতি গোত্র ধর্ম বর্ণের সবাইকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। ফলে, জমিদার পরিচিতি পেতে তাঁকে বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু কষ্টের কথা কী, সাধ করে বানানো দীঘি জলে টইটুম্বুর না হওয়া নিয়ে কথিত আছে, তিনি না কী স্বপ্নে দেখেন, তারই ছোট মেয়েকে নববধূ রূপে সাজিয়ে দিলে দীঘির জল থই থই করবে। প্রথমে জমিদার ভুলু পোদ্দার কথাটিকে গুরুত্ব না দিলেও পরবর্তী স্বপ্নে তিনি সাঁই দেন। যথারীতি স্বপ্নানুসারে মেয়েকে নবববূ করে দীঘির জলে স্নান করালে পরিপূর্ণ জল দেখা যায়। অনেকেই আবার দ্বিমত করতে শোনা যায় এই কল্পকথাকে। কালের বিবর্তনে ভুলু পোদ্দারের দীঘি এক সময় “বলুয়ারদীঘি” নামে প্রসিদ্ধ লাভ করে। পঞ্চাশের দশকের পূর্বে জমিদারী বিলুপ্তি হতে লাগলে বলুয়ারদীঘির মালিকানাও বদল হতে থাকে। ভুলু পোদ্দারের পর বলুয়ারদীঘির মালিকানা বদলে যায় জমিদার অবিনাশ চৌধুরীর নিকট। তিনিও বেশিদিন ঠিকতে পারেননি। জানা গেছে, পরবর্তীতে মালিকানার ক্ষেত্রে আবু নঈম, হাজি আবদুল আজিজ সওদাগর, বজলুর রহমান চৌধুরীসহ অনেক ক্রেতার নাম যুক্ত হয়ে যায় বলুয়ারদীঘি জল ও জলাধারকে ঘিরে। ষাট সত্তর দশকের পরেও বংশ পরম্পরায় সমসাময়িক কালে এসে বলুয়ারদীঘির মালিকানা পরিবর্তন হতে থাকে, এলাকার বর্ষীয়ান লোক তখনকার কোরবানীগঞ্জ মসজিদের সাধারণ সম্পাদক সূত্রে তাঁর জীবদ্দশায় গবেষকের সূত্রে জানা যায়,আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ সওদাগর আলকাদেরী (রঃ), প্রবীণ সমাজসেবক শিক্ষানুরাগী আলহাজ্ব আবদুল কালাম সওদাগর, আলহাজ্ব আবদুল হাকিম সওদাগর খরিদসূত্রে বলুয়ারদীঘির মালিকানা প্রাপ্ত হন। পরবর্তী পর্যায়ে এসে তাদের ওয়ারিশগণ দীঘির মালিকানা লাভ করেন। তবে বলুয়ারদীঘির চারপাশের পাড়ের অংশে অনেকেই মালিক রয়েছেন। পারিবারিক সূত্রে কিম্বা উত্তরাধিকার সূত্রে এই দীঘির মালিকানা অনেকের হাতেই আছে। এখানে সবারই নাম লিখার ক্ষেত্রে লেখকের সীমাবদ্ধতাটুকু অবশ্যই মার্জনীয় রেখেই বলতে চাই, দীঘির হৃত গৌরব ফিরে পাক এটা চট্টগ্রাম মহানগরের জনদাবি।
শত বছরের এই দীঘিটি ভরাট হতে হতে এখন জরাজীর্ণ অবস্থায় পতিত হয়েছে। সুন্দর সৌম্য ঐতিহ্যের প্রতীক বছরের পর বছর ধরে বলুয়ারদীঘির দুই পাড় (পূর্ব পশ্চিম ভরাট হতে হতে আগেকার সেই জৌলুস হারিয়ে গেছে। দেওয়ানবাজার সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যমান বলুয়ারদীঘিকে ঘিরে এখানে কোরবানীগঞ্জ জামে মসজিদ, খানকা শরীফ (খানকায়ে কাদেরিয় সৈয়দিয়া তৈয়্যবিয়া), অভয়মিত্র মহাশ্মশান, কালী বাড়ী, চারটি স্কুল– বলুয়ারদীঘি সরকারি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়, বলুয়ারদীঘি সরকারি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়, লামাবাজার সরকারি প্রাথমিক বালক বিদ্যালয়, লামাবাজার আছদ আলী সওদাগর সিটি কর্পোরেশন বালক উচ্চবিদ্যালয় অবস্থিত। দিনে রাতে ময়লা আবর্জনা আর প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিপূর্ণ হয়ে পড়ছে এ দাবি স্থানীয় জনগণের। উত্তর দক্ষিণ পাড় কোন পাড়ই আজ রক্ষা পাচ্ছে না। বলুয়ারদীঘি এমন একটি ঐতিহ্যের ধারক যেখানে রয়েছে হাজারো মানুষের জীবন যাপনের নানা অনুষঙ্গ। কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই নয়, মসজিদ– মন্দিও, ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোও এর অতি নিকটেই অবস্থান করছে। যুগ পরম্পরায় এ এলাকায় ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য উদাহরণ রয়েছে। অনতিদূরেই রয়েছে চাক্তাই খাতুনগঞ্জের মত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও বৃহৎ বাণিজ্যিক এলাকা । দীঘিতে প্রতিদিন গোছল করে থাকে অসংখ্য মানুষ। দিন দিন পানি এতো নোংরা ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে এখানে দীঘির সেই স্বচ্ছ জলের ধারা হারিয়ে গেছে কবে কখন। দীঘির পাড় লাগোয়া মসজিদের মুসল্লিরা অজু করতেও বিব্রত বোধ করেন। শ্মশানে মৃতদেহ সৎকার করে সবেধন নীলমণি বলুয়ারদীঘির জলে স্নান করে থাকেন বটে। নাগরিকদের মতামত, যেভাবে বলুয়াদীঘি ভরাট দূষণ হচ্ছে ততে করে ঐতিহ্য শুধু নামেই থাকছে। সেই সাথে দূঃসহ বেদনার বিষয় যে, সেদিন বেশি দূরে নয়, হয়তো বলূয়ারদীঘিকে ঘিরে কোন অগ্নিকাণ্ড দেখা দিলে তাতে আগুন নেভানো কঠিন হয়ে পড়বে। প্রায়শঃই এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। পরিবেশবাদী, সমাজ সচেতন নাগরিক সহ নানা পর্যায় থেকে মাঝে মাঝে দীঘি ভরাট করার প্রবণতা রোধ করার দাবি ওঠে সরকারি বেসরকারি সংস্থা, জেলা প্রশাসন,পরিবেশ অধিদপ্তর, সিডিএ এমনকি সিটিকর্পোরেশনের নিকটও। কিন্ত সত্যিকার আলোর মুখ দেখা যায়নি আজও। তবে, মালিক পক্ষ ও স্থানীয় জনগনও চায়, বলুয়ারদীঘি সুন্দরভাবে সংস্কার হোক। এলাকার সমাজসেবকদের অনেকেই জানান, বিএস জরীপের ভিত্তিতে দীঘির সীমারেখা নির্ধারণের মাধ্যমে কাউকে ক্ষতির সম্মুখীন না করে দীঘিকে পূর্বের অবসথায় ফিরিয়ে আনা হোক। দীঘিতে সু–স্বাদু মাছ উৎপাদন,নাগরিকদের নিত্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারে দীঘির স্বচ্ছ জলধারা মানুষের মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে সত্যিকার সুখের ফোয়ারা হয়ে উঠুক, এটাই সকল গোষ্ঠীর জনদাবি।
লেখক: কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক।











