ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলী খেলা

মহিউদ্দিন ইমন | মঙ্গলবার , ২২ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

ভারতবর্ষের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের পতনের পর সেই দেশে বৃটিশ শাসন শুরু হয়েছিল। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসমপ্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের বদরপতি এলাকার ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর বলী খেলা বা কুস্তি প্রতিযোগিতার প্রবর্তন করেন।

১৯০৯ সালে নিজ নামে লালদিঘির মাঠে এই বলীখেলার সূচনা করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজনের জন্য ব্রিটিশ সরকার আবদুল জব্বার মিয়াকে খান বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ছাড়াও বার্মার আরাকান অঞ্চল থেকেও নামী দামি বলীরা এ খেলায় অংশ নিতেন।

আবদুল জব্বারের মৃত্যুর পর এই প্রতিযোগিতা জব্বারের বলী খেলা নামে পরিচিত লাভ করে। এই বলী খেলা একটি জনপ্রিয় এবং ঐতিহ্য মণ্ডিত প্রতিযোগিতা হিসেবে বিবেচিত। বলী খেলা মূলত কুস্তি খেলা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কুস্তি খেলাকে বলী খেলা বলা হয়, এই খেলার প্রধান আকর্ষণ হাজার হাজার দর্শকদের অনুপ্রেরণা এবং ভালোবাসা। দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন আসে এই বলী খেলা উপভোগ করার জন্য। বিশেষ করে তরুণরা কুস্তিগীরদের শারীরিক গঠন সুঠাম দেহ অনেক কিছুই অনুসরণ করে। একসময় চট্টগ্রাম কে বলা হতো বলীর দেশ। কালের আবর্তনে চট্টগ্রামের অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে, কিন্তু এই জব্বারের বলী খেলা বর্তমানে দেশের বৃহত্তম লোকজ উৎসব হিসেবে বিবেচিত।

এখন পেশাদার বলির কুস্তিগীর অভাবে বলিখেলার তেমন আকর্ষণ না থাকলেও জব্বারের বলীখেলার মূল উপজীব্য হয়ে উঠেছে মেলা। তাই অনেকে বলীখেলার পরিবর্তে একে বৈশাখী মেলা হিসেবেই চিনেন। জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অহংকারে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় লোকজ উৎসব হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়। খেলাকে কেন্দ্র করে তিন দিনের আনুষ্ঠানিক মেলা বসার কথা থাকলেও কার্যত পাঁচ ছয় দিনের মেলা বসে লালদিঘির ময়দানের চারপাশের এলাকা ঘিরে।

কারণ এই মেলাতে গৃহিণীদের ঘরের গৃহস্থালির সব ধরনের ব্যবহার্য পণ্য সামগ্রী সহজে কেনা যায়। ছোট ছোট শিশুদের জন্য বর্তমান সময়ে হারিয়ে যাওয়া অনেক খেলার সামগ্রী এই বলী খেলার মেলায় পাওয়া যায়। তরুণীদের কাচের চুড়ি, মাটির গহনা নানান রকম প্রসাধনী পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য মৃৎশিল্পীদের বিরাট একটা অংশ এখানে ব্যবসার উদ্দেশ্যে মিলিত হয়। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বৈশাখী ঝড় না হলে তাদের ব্যবসা খুব ভালোই চলে। মানুষ বিভিন্ন ধরনের মাটির সামগ্রী, ফুলের টব, ঘর সাজানোর টেরাকোটা অনেক কিছু সেখান থেকে ক্রয় করে। বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই মেলাটির ভূমিকা সত্যিই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষা, মানবতা ও উৎপাদন : জাতি গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর