ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র : একটি পর্যালোচনা

আলমগীর মোহাম্মদ | বৃহস্পতিবার , ১৪ আগস্ট, ২০২৫ at ১১:৩২ পূর্বাহ্ণ

অগাস্ট ৫, ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য দিন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ ২৩ বছরের বৈষম্য, দুঃশাসন ও শোষণের শেকল ছিঁড়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো এই জাতি বারবার হোঁচট খেয়েছে স্বৈরাচারের চৌকাঠে। মানুষ কেঁদেছে অঝোরে, মরেছে বেঘোরে এবং ভুগেছে অকাতরে। ১৯৯০ সালের গণ অভ্যুত্থান বাংলাদেশীদের দ্বিতীয়বার মুক্ত বাতাসের যোগান দিয়েছিল। নিজেদের ভুলে, লোভের ফাঁদে পড়ে, অনৈক্যের ফাঁটাবাঁশের চিপায় আটকে পড়েছিলো তাঁরা। তার খেসারত দিতে হয়েছে দীর্ঘ ২০০৮২০২৫ সতেরো বছর। অবশেষে জুলুমের প্রাথমিক অবসান ঘটে জুলাই বিপ্লবে স্বৈরাচারের পতনের মাধ্যমে। তাই জুলাই সনদের দিকে দেশের শিক্ষার্থীজনতার ছিলো চাতকের দৃষ্টি। সবারই তীব্র আগ্রহ কী আছে এই সনদে? ছাত্রজনতার চাওয়ার প্রতিফলন ঘটবে তো, নাকি পুরনো ভুলের পুরনো বৃত্তে আটকা পড়বে সকল চাওয়া।

জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের পাশে রেখে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এই ঘোষণা বাংলাদেশপন্থীদের খুশি করতে পারলেও নাখোশ, নারাজ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া এসেছে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলের চুপা সমর্থক, পালিয়ে থাকা তাদের তৃতীয় শ্রেণির কিছু অর্বাচীন নেতা এবং দেশের স্বাধীনতা অস্বীকার করা একটা দলের সমর্থকদের কাছ থেকে। তাঁদের সাথে যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশ নিয়ে অতি আগ্রহী একজন বিদেশী আইনজীবীও।

দেশমাতার মুক্তি, স্বাধীনতা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গোড়ায় গলদ ছিলো বাহাত্তরের সংবিধান ও দেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে দেশের প্রথম নির্বাচনকে কলংকিত করেন। বিরোধীদলীয় নেতাদের নির্বাচনী প্রচারে বাধা দান, ভোট কারচুপি, ব্যালট ছিনতাই এবং সর্বোপরি একটা অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন ও সংবিধানে নিজের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটান একদলীয় বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে। তার শাসনামলে চরম অপশাসন, সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটতরাজ দেশকে দারিদ্র্যের জালে আটকে ফেলে। দুর্ভিক্ষে মারা যায় প্রায় বাইশ হাজারের অধিক মানুষ। এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচন ছিলো এদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক রাষ্ট্রীয় অন্যায় যার খেসারত জাতি দিচ্ছে আজো। এবং শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল ছিলো দুঃশাসনের একটা বাস্তব চিত্র।

১৯৭৫ সালের পনেরো আগাস্ট সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ‘প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর দেশে সিপাহীজনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে একদলীয় বাকশাল পদ্ধতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পুনঃপ্রবর্তনের পথ সুগম হয়’। কিন্তু সেটাও দীর্ঘকাল ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। অবশ্যই জুলাই ঘোষণাপত্র বীর উত্তম ও স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের শাসনকাল ও সামরিক বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ নেই। তাঁর জাতীয়তাবাদী নীতি ও বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা আরেঠারে স্বীকার করা হয়। যা একটি ঐতিহাসিক সত্যের উপর বালিশ চাপা দেওয়ার শামিল।

জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার পর দেশে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেন। তার নয় বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতা দীর্ঘ নয় বছর আন্দোলন করে অবশেষে ১৯৯১ একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। জুলাই ঘোষণাপত্রে এই নির্বাচনের কথা উঠে আসলেও ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনের কথা জুলাই সনদে সম্পূণরূপে অনুপস্থিত। তারপর দেশে নেমে আসে এক এগারোর খড়গ। জুলাই সনদে যা বিবৃত হয়েছে এভাবে, ‘দেশীবিদেশী চক্রান্তে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ১/১১ এর ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতা, আধিপত্য ও ফ্যাসিবাদের পথ সুগম করা হয়’। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। শেখ হাসিনার একদলীয় শাসনচিন্তার বলি হয় বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা। সর্বস্তরের নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে প্রহসনে রূপান্তরিত করে হাসিনা চালু করে জুলুম, খুন, হত্যা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মহড়া। সংবিধানকে করে তোলা হয় দলীয় ইশতেহারে। বিচার ব্যবস্থায় নগ্ন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একের পর এক জনবিরোধী সংশোধনী এনে গণতন্ত্রের গলাচেপে ধরা হয় এই আমলে। জুলাই ঘোষণাপত্রে যা বিবৃত হয়েছে এভাবে; ‘গত দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী, অগণতান্ত্রিক এবং গণবিরোধী শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে এবং একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অতি উগ্র বাসনা চরিতার্থ করার অভিপ্রায়ে সংবিধানের অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক পরিবর্তন করা হয় এবং যার ফলে একদলীয় একচ্ছত্র ক্ষমতা ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়’।

আওয়ামী লীগ ও তাদের কতিপয় মিত্রদল যাদের জনসম্পৃক্ততা প্রায় শুন্যের কোটায়, তাদের নিয়ে পরপর তিনটি নির্বাচনে ডামি নির্বাচনের আয়োজন করে। একচেটিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। বিনা ভোটে ১৫১ জন এমপি নির্বাচন, রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি এবং বিরোধীদলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ আওয়ামীলীগ সরকার দেশের মানুষকে এভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। জুলাই ঘোষণাপত্রে তা উঠে এসেছে এরভাবে– ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার তিনটি প্রহসনের নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচন) এদেশের মানুষকে ভোটাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত করে’। এই তিনটি নির্বাচনের পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হয়ে উঠে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকার’। রাষ্ট্র, সরকার ও দল হয়ে উঠে এক ও অভিন্ন। অপরিকল্পিত উন্নয়নের দামামা বাজিয়ে সীমাহীন দুর্নীতির আখাড়া হয়ে উঠে রাষ্ট্রের একেকটি প্রতিষ্ঠান। সরকারি চাকরিতে নগ্ন দলীয়করণ, রাজনৈতিক স্বজনপ্রীতি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে আর্থিক লেনদেন এবং সিভিল সার্ভিসসহ যে কোনো চাকরিতে অযৌক্তিকভাবে কোটা প্রয়োগের ফলে তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে গত বছর জুলাইয়ের শুরুতে। প্রতিবাদী শিক্ষার্থীজনতার উপর চলে অমানবিক নির্যাতন। সে নির্যাতন ও অন্যায়ের কথা প্রতিফলিত হয়েছে জুলাই ঘোষণাপত্রে, ‘আওয়ামী লীগ আমলে ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতাকর্মী, শিক্ষার্থী ও তরুণদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় এবং সরকারি চাকরিতে একচেটিয়া দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যের কারণে ছাত্র, চাকরি প্রত্যাশী ও নাগরিকদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম হয়’।

সেই ক্ষোভ দানাবাধে যখন সরকার আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে ছাত্রজনতার শান্তিপূর্ণ প্রত্বিাদে গুলি চালায়। ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে দেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয় এবং কারফিউ চালিয়ে গণহত্যা চালায়। সরকার যখন ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার নগ্ন বাসনা চরিতার্থ করতে উঠে পড়ে লাগে। তখনই দেশের সর্বস্তরের জনতা যোগ দেয় ছাত্রজনতার এই বিপ্লবে। শত শত শিক্ষার্থী, শিশু, নারী ও পেশাজীবী প্রাণ হারায়। আহত ও পঙ্গু হয় হাজার হাজার মানুষ। তাদের এই ত্যাগের বিনিময়ে জাতি ফ্যাসিস্টের কবল থেকে মুক্তি পায়। জনগণের দাবি অনুযায়ী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের আলোকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। জুলাই ঘোষণাপত্রে এসেছে, ‘যেহেতু জনগণের দাবি অনুযায়ী এরপর অবৈধ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে সুপ্রীম কোর্টের মতামতের আলোকে সাংবিধানিকভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট ২০২৪ তারিখে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়’।

ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর জনগণের তীব্র চাওয়া ছিলো রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের সহযোগী ও খুনীদের যথাসময়ে বিচার করা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা করতে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে জুলাই ঘোষণাপত্রে অন্তর্বর্তীকালীন তাদের ইতিবাচক অভিপ্রায় উঠে এসেছে– ‘বাংলাদেশের জনগণ সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ, আইনের শাসন এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে’।

জুলাই ঘোষণাপত্রের অন্যতম ইতিবাচক দিক হলো গণঅভ্যুত্থানে প্রাণ দেওয়া সকল শহীদকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আহতদের সকল প্রকার আইনি ও চিকিৎসা সুরক্ষা দেওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ‘আইনের শাসন ও মানবাধিকার, দুর্নীতি, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন ও মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়’ ব্যক্ত করা হয়েছে।

লেখক : শিক্ষক ও অনুবাদক। সহকারী অধ্যাপক ও হল প্রভোস্ট, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআকাশ আহমেদ-এর অনুপম ছড়াগ্রন্থ ‘ব্যাঙের মাথায় ব্যাঙের ছাতা’
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম