আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিস্টরা এখনো উঁকিঝুঁকি মারছে জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, জাতি তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং তাদের নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়। এ কারণেই ঐক্য ঘটানো হয়েছে। যে কয়েকটি সংস্কার জাতীয় ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে হবে সেগুলো সহসা করে ফেলুন, এরপর নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যান। যে সংস্কারে ঐকমত্য হবে না তার বিষয়ে আগামী দিনে বাংলাদেশের মানুষ, নির্বাচনের মাধ্যমে যে সংসদ হবে তারা এবং নির্বাচিত সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এর বাইরে অনির্বাচিত কারো কোনো অধিকার নেই।
জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে গতকাল শনিবার বিকালে কাজীর দেউড়ির আলমাস সিনেমা হল মোড়ে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপির র্যালিপূর্ব সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার ও এস এম ফজলুল হক। প্রধান বক্তা ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম। নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিব নাজিমুর রহমানের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাবেক সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাসেম বক্কর, কেন্দ্রীয় বিএনপির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক হারুনুর রশিদ ও ব্যারিস্টার মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য শামসুল আলম, সাথী উদয় কুসুম বড়ুয়া ও উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ হালিম। সমাবেশ শেষে বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। কাজীর দেউড়ি মোড়, নূর আহমেদ সড়ক, এনায়েত বাজার মোড়, জুবিলি রোড, তিন পুলের মাথা, আমতলা মোড় হয়ে নিউ মার্কেটে স্বাধীনতা চত্বরে এসে শেষ হয়। র্যালিতে অংশ নেন নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। র্যালিতে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে অংশ নিতে দেখা গেছে।
আমীর খসরু বলেন, আগে তো এক দফা ছিল না। কেন এক দফা জানেন? আমরা বলেছি, এক দফার মাধ্যমে শেখ হাসিনার যদি পতন না হয় তাহলে আপনারা যত দফা দিবেন কোনো দফা কাজে আসবে না। তারপর আপনারা এক দফায় আসছেন, আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আর শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। এটাই সত্য, এটা বুঝুন। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিত্বহীন কোনো সরকার জনগণের কথা ও কষ্ট বুঝবে না। কারণ বুঝতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে এবং জনগণের পাশে থাকতে হবে। জনগণের দুঃখ–দুর্দশা বুঝতে হবে। বিল দিতে পারছে না, সেটা বুঝতে হবে, দুবেলা খেতে পারছে না সেটা বুঝতে হবে।
খসরু বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান একটা বয়ান দিয়ে কিছুদিন স্বৈরাচারী রাষ্ট্র চালিয়েছেন। সেটা টিকেনি। জনগণের সামর্থ্য ছাড়া কিছু টিকে থাকে না। পরবর্তীতে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ আরেক বয়ান দিয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তাকে আমরা পরাজিত করে পাঠিয়ে দিয়েছি।
তিনি বলেন, এখন আবার আরেক বয়ান। বাংলাদেশে কখন নির্বাচন হবে তা এ বয়ানের মধ্যে নেই। বাংলাদেশের জনগণ কবে ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচিত করবে সেই বয়ান নেই। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেয়ে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হবে, সেই বয়ান নেই। বয়ান হচ্ছে সংস্কারের বয়ান। আরে সংস্কার কি আপনারা বিএনপির আগে দিয়েছেন? ৬ বছর আগে বেগম খালেদা জিয়া সংস্কারের কথা বলেছিলেন। কারণ আমরা জনগণের কষ্ট বুঝেছি বলে দিয়েছি। এক বছর আগে তারেক রহমানের নেতৃত্ব আমরা সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি। ওই সংস্কারে সবকিছু আছে। কিছু বাকি নেই। আপনারা যা বলেছেন তাও আছে, তার বাইরেও আছে। সংস্কারে আপনাদের চেয়ে আরো বেশি আছে।
এ সময় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান যে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন তা অটুট রাখার আহ্বান জানান খসরু। একইসঙ্গে ঐক্য ধরে রেখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, নির্বাচন এবং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ নির্বাচিত সরকারের দিকে যেতে হবে বলেও মন্তব্য করেন। ‘তারেক রহমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না’ বলেছেন উল্লেখ করে খসরু বলেন, তাদের আমরা শেষ পর্যন্ত সমর্থন দেব। আমরা এ সরকার আসা মাত্রই সমর্থন দিয়েছি, এখনো সমর্থন দিচ্ছি। আমরা চাই এ সরকার গণতন্ত্রের অধিকার ফিরিয়ে আনবে। তার জন্য আমরা সকলে মিলে কাজ করব। আমাদের ঐক্য নষ্ট করা যাবে না।
তিনি বলেন, সিপাহি জনতার সহযোগিতায়, সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের মানুষ জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশে এক নতুন ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে ৭ নভেম্বর। শেখ মুজিবুর রহমান, বাকশাল, আওয়ামী লীগ, ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। শহীদ জিয়াকে মুক্ত করার মাধ্যমে এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা হয়েছিল। সেই বাংলাদেশ হলো বহুদলীয় গণতন্ত্রের বাংলাদেশ। সেই ধারা অব্যাহত রেখে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারের বিরুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে স্বৈরাচারদের পতন ঘটিয়েছেন।
তিনি বলেন, ১/১১ পরবর্তী সময়ে কিছু লোকের মাধ্যমে মানুষের সকল অধিকার কেড়ে নিয়ে আবারো একটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়ে দেশের ভেতরে এবং দেশের বাইরে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে, বিএনপিকে সেদিন তারা পরাজিত করেছিল। পরবর্তীতে ওই স্বৈরাচারকে আবারো ক্ষমতায় বসিয়েছে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে দিয়ে, বিএনপির সাত লাখের অধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন, গুম, হত্যা, জেল হত্যা, পুলিশের হেফাজতে হত্যার মাধ্যমে সেদিন বাংলাদেশে আবারো একটি নিরাপত্তাহীন জনগণের জন্য পরাধীন জাতি সৃষ্টি করেছিল। সেখানে আবারো দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। এজন্য তাকে জেলে যেতে হয়েছে, জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং তাকে চিকিৎসা না দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর আন্দোলন শুরু হয়েছিল তারেক রহমানের নেতৃত্বে সমস্ত দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। ছাত্র–জনতা, সর্বস্তরের মানুষকে তারেক রহমানের নেতৃত্বে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে আমরা শেখ হাসিনাকে মোটামুটি পরাস্ত করতে পেরেছিলাম।
খসরু বলেন, যে আন্দোলন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে, আমাদের নেতাকর্মীরা বাড়ি–ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, চাকরি হারাতে হয়েছে, ব্যবসা হারাতে হয়েছে, পঙ্গু হতে হয়েছে, জেলে যেতে হয়েছে। তোমরা কয়জন? সব হিসাব করলে কিন্তু অসুবিধা আছে। আমরা কিন্তু হিসাব করতে চাচ্ছি না। আমরা চাচ্ছিলাম, সবাই মিলে শেখ হাসিনাকে বিদায় করে দিতে। দেশ একটা গণতন্ত্রের অবস্থা ফিরিয়ে আনুক। গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশবাসী তাদের ভোটে যাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, সংসদে যাবে, সরকারে যাবে, তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে। জবাবদিহিতাহীন কোনো সরকার বাংলাদেশের কল্যাণ করতে পারবে না।
তিনি বলেন, আপনাদের মনে আছে, লাখ লাখ মানুষ চট্টগ্রামের পলোগ্রাউন্ডে, লাখ লাখ মানুষ প্রত্যেকটি বিভাগীয় শহরে সবকিছু উপেক্ষা করে জীবনের বিনিময়ে উপস্থিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ঢাকাতে গুলি করে বিএনপির সমাবেশ পণ্ড করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার সেই আশা তারেক রহমানের নেতৃত্ব গুণের কারণে সফল হয়নি। তারেক রহমানের নেতৃত্বে সমস্ত দেশ ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কারণে শেষ ধাক্কা যখন দিয়েছে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। সেই পটভূমি এবং অবস্থা সৃষ্টি না হলে শেখ হাসিনাকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর সুযোগ ছিল না। এখন অনেক গল্প শুনছি, শেখ হাসিনার পতনের গল্পের শেষ নেই। প্রত্যেক দিন নতুন নতুন গল্প শুনছি। ওরা নাকি এটা করেছে, সেটা করেছে। ১৫ বছর যখন আমরা রাস্তায় আন্দোলন করেছি, জীবন দিয়েছি, গুম–হত্যার শিকার হয়েছি, জেলে গিয়েছি বারবার, তখন তো তোমাদের এসব গল্প দেখিনি। তোমাদের ছিল কেউ? আমাদের সঙ্গে তো তখন কেউ আসেনি।
গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমান সারা দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। আজ তারেক রহমানের নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ।
মাহবুবের রহমান শামীম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশ–বিদেশে এখনো সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে পরাজিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে বিএনপির নেতাকর্মীসহ দেশপ্রেমিক জনতাকে সজাগ থাকতে হবে।
আবুল হাশেম বক্কর বলেন, শেখ হাসিনা ও তার দোসররা এখনো ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। ঐক্যবদ্ধভাবে সব ষড়যন্ত্র রুখে দিতে হবে।
মীর মোহাম্মদ হেলাল বলেন, ৭ নভেম্বরের ছুটি অবশ্যই পুনর্বহাল করতে হতে হবে।