রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে দল-মতের পার্থক্য ভুলে আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতীয় সংসদে বছরের প্রথম অধিবেশনে ভাষণে গতকাল সোমবার তিনি আরো বলেন, দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুশাসন সুসংহতকরণ, গণতন্ত্র চর্চা ও উন্নয়ন কর্মসূচিতে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকারের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।
আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে আমাদের আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। আসুন, দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহিদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি। খবর বাসসের।
জাতীয় সংসদকে দেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, গণতন্ত্রায়ন, সুশাসন ও নিরবচ্ছিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এ লক্ষ্যে তিনি সরকারি দল ও বিরোধী দল নির্বিশেষে জাতীয় সংসদে যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের সময় করোনাকালের স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি ও বিরোধি দলের সংসদ সদস্যগণ অধিবেশনে অংশ নেন। এর আগে ৪টা ৫৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি অধিবেশনে প্রবেশ করেন। এ সময় নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বিকেল ৫টা ৫৮ মিনিটে রাষ্ট্রপতি ভাষণ শুরু করেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ৩ দশমিক তিন-দুই কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহু লেন বিশিষ্ট টানেলের নির্মাণকাজ ডিসেম্বর ২০২২ সাল নাগাদ সম্পন্ন হবে। ইতোমধ্যে টানেলের ১ম টিউবের নির্মাণ শেষে গত ১২ ডিসেম্বর ২০২০ থেকে ২য় টিউবের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। শত বাধা বিঘ্ন আর প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সরকার দেশের উন্নয়ন, সুসাশন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি অর্থনীতি, বাণিজ্য-বিনিয়োগ, খাদ্য-কৃষি, পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের কার্যক্রম ও সাফল্য তুলে ধরেন। এছাড়া দেশে আইনের শাসন সুসংহত ও সমুন্নত রাখা এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের কার্যক্রমের প্রশংসা করেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে ‘পদ্মা বহুমুখী সেতু’র দুই প্রান্তের মাওয়া ও জাজিরা সংযোগকারী সর্বশেষ ৪১তম স্প্যান স্থাপন করার মাধ্যমে সেতুর ছয় দশমিক এক-পাঁচ কিলোমিটার মূল অবকাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ জুলাই ২০২২ সাল নাগাদ সমাপ্ত হবে। এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে অন্যান্য অঞ্চলের সমম্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে সব ক্ষেত্রেই অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। সমপ্রতি সরকারের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সাফল্যের সাথে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাবে গোটা বিশ্বের ন্যায় আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পসহ অর্থনীতির সকল সেক্টরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা নির্দেশনাসহ ভার্চুয়াল কনফারেন্সের মাধ্যমে নানামুখী দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
শেখ হাসিনার দৃঢ়, প্রাজ্ঞ, দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সাহসী সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি সাফল্যের সাথে মোকাবিলা করে এসব উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে।
আবদুল হামিদ বলেন, এর ধারাবাহিকতায় প্রথিতযশা সাময়িকী ‘ফোর্বস’ কর্তৃক প্রকাশিত বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সফল রাষ্ট্রনায়ক ও নারী নেতৃত্বের তালিকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ জনিত প্যানডেমিকের সফল মোকাবিলা, অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও জীবনমান সচল রাখার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ প্রণীত ‘কোভিড-১৯ সহনশীল র্যাংকিং’-এ বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষ এবং বিশ্বে ২০তম স্থান অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে। এজন্য তিনি তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
আবদুল হামিদ বলেন, কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বেঙ্মিকো ফার্মাসিউটিকেলস লিমিটেড এবং ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব লাইফ সাইনসেস প্রাইভেট লিমিটেডের সাথে ৩ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সরাসরি ক্রয়ের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় সিএমএসডির মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিন ক্রয় বাবদ ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে প্রদান করা হয়।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, সরকার খুব শিগগিরই দেশের জনগণকে কোভিড-১৯-এর টিকা প্রদান করতে পারবে। আর্থিক খাত ব্যবস্থাপনায় সরকারের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপ্রধান হামিদ বলেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও উৎকর্ষ সাধন এবং প্রাজ্ঞ রাজস্ব নীতি ও সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
গত এক দশকে গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ ও পর পর তিনবছর ৭ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক এক-পাঁচ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে তিনি ভাষণে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির এ ধারাবাহিক অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।
আবদুল হামিদ বলেন, আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে। শান্তি, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যে পথে আমরা হাঁটছি, সে পথেই আমাদেরকে আরও এগিয়ে যেতে হবে। এ বছর মধ্য-আয়ের দেশ হিসাবে আমরা ‘স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী’ পালন করবে।