এ নগরের যত হাট-বাজার

স্মৃতির শহর চট্টগ্রাম

কুমার প্রীতীশ বল | মঙ্গলবার , ২৬ নভেম্বর, ২০২৪ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

অঞ্চল সংস্কৃতি গবেষক সুপ্রিয় ঘোষ ‘নদিয়ার হাটহদ্দ’ বইতে বৃহত্তর বাংলার হাটের ইতিহাস, ভূগোল তুলে এনেছেন। তখন মনে হলো, হাটবাজার তো এ জনপদেও আছে। এ নিয়ে আমিও অনেক কথকতা শুনাতে পারি। আমি আরও উৎসাহি হই, রামামৃত সিংহ মহাপাত্র যখন লেখেন, ‘হাট। বাঙলার গ্রামীণ ও গঞ্জসংস্কৃতির এক দুরন্ত জমায়েত। হরেক কিসিমের সামগ্রী কেনাবেচা সেই বিচিত্র ক্রিয়াকাণ্ডের একটি অংশমাত্র।’ হাট নিয়ে অনেক প্রবচন, কবিতা বাংলা ভাষাভাষি মানুষের মুখে মুখে। রবীন্দ্রনাথের ‘হাট’ কবিতায় গ্রামীণ হাটবাজারের একটি পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর সমস্যাপূরণ গল্পেও হাটের কথা আছে। ‘বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকীর্তন কাব্যে শ্রীরাধিকারমথুরার হাটে দধিদুগ্ধের পসরা বিক্রি করতে নিয়ে যাবার সুন্দর চিত্র বর্ণণা করা হয়েছে।’ ‘এ হাটের অস্তিত্ব ছিল পালযুগেও’। হাটবাজারে যাওয়াআসার অভ্যাস আমার শৈশবকৈশোরে ছিল না, বর্তমানেও নেই। শৈশবকৈশোরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। আমার মায়ের হয়ত ‘ছেলে নষ্ট হাটে, বউ নষ্ট ঘাটে’প্রবচনটি জানা ছিল।

শৈশবে হাটের দিন দুপুর হতেনা হতেই স্কুলের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। শান্তি জেঠামনির বড়ছেলে রতনদা খালি ব্যাগ আর ভাতের বাটি হাতে নিয়ে ছুটেছেন। রতনদা ভাত নিয়ে গেলে শান্তি জেঠামনি খাবেন, তাই দ্রুত পায়ে রতনদা লুঙ্গি পরে ছুটতেন। কালীহাটে জেঠামনির আফিনের দোকান ছিল। কখনও কারো সঙ্গে ‘কালীহাট’এ গেলে (কখনও একা হাটে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এখনও একা যাওয়া হয় না।) প্রথমেই শান্তি জেঠামনির দোকানে একটা বিরতি দিতে হতো। প্রায় অন্ধকার দোকানটিতে খরিদদাররা এসে আফিন (অনেক পরে জেনেছি ওটা আফিন ছিল। তখন জানতাম কালো মাটি) কিনে গিয়ে যেত। শান্তি জেঠামনির পেছনে রতনদা বসে থাকত। আমি যার সঙ্গে যেতাম কিছু সময় বিরতির পর বাজার করতে হাটে ঢুকে যেতাম। কখনও একবারে কখনও বিরতি দিয়ে বাজার শেষ করে শান্তি জেঠামনির দোকানে আসতাম। তারপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতাম। শান্তি জেঠামনির বাজারের স্টাইলে একটু ভিন্নতা ছিল। তিনি হঠাৎ করে রতনদাকে বলতেন, যাতো আলু দেখে আয়তো। রতনদা গিয়ে দেখে আসলেন। আবার কিছুক্ষণ কোনো খবর নেই। আবার হঠাৎ করে বললেন, যাতো আলুর দামটা দেখে আয়তো। রতনদা দাম দেখে আসলেন। দাম শুনে আবার আরও কিছুক্ষণ পর টাকা দিয়ে বলতেন, যা একসের আলু নিয়ে আয়। এভাবে রাত অবধি রতনদা আর জেঠামনির বাজারসদাই চলত। হারিকেন জ্বালিয়ে তাঁরা যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন আমরা ঘুমিয়ে পরতাম। কালীহাট বসত শনি, মঙ্গলবার। প্রতিদিন সকালে আমাদের বাড়ির কাছে একটা বাজার বসত। হরিমোহন মাস্টার এ বাজারের গোড়াপত্তন করেন, তাই গ্রামবাসী নাম রেখেছে ‘মাস্টার বাজার’। এর আদিনাম ছিল খুব সম্ভব হাটখোলা। কালীহাটে একটা কালীবাড়ি ছিল ও থেকে নামকরণ কালীহাট হয়েছে। তবে কে বসিয়েছেন জানি না। কালীহাটে শান্তি জেঠামনির দোকানের সামনে লম্বা চুলওয়ালা, ধুতিপাঞ্জাবি পরিহিত একটা লোক একটি কাঁশার মাটিতে আংটি রেখে বাটির চতুর্দিকে লাঠি ঘুরাত। আংটিটা ঘুরত। তারপর বিক্রি করত। কেন আংটিটা মানুষ ধারণ করত, এখন আর মনে নেই ।

কালীহাট ‘হাট’ কেন, মাস্টারবাজার ‘বাজার’ কেন? আমাদের একটা ব্যাখা ছিল, যা লিখে স্কুলের পরীক্ষায় পূর্ণ নম্বর পেয়েছিলাম। কালীহাট সপ্তাহে দু’দিনশনি, মঙ্গলবার বিকালে বসে, একারণে ওটি ‘হাট’। মাস্টার বাজার প্রতিদিন সকালে বসে, এ কারণে ‘বাজার’। তখনও জানতাম না, বক্সিরহাট সকালবিকালদিনরাত বসেও ‘হাট’। আবার রেয়াজুদ্দিন বাজার সকালবিকালদিনরাত বসেও ‘বাজার’।

শহর চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত রেয়াজুদ্দিন বাজারের পুরো এলাকাটির আদিমালিক ছিলেন জমিদার দেওয়ান বৈদ্যনাথ। এখানে তাঁর বাগান বাড়ি ও সেগুনবাগিচা ছিল। চট্টগ্রামনোয়াখালির প্রথম মুসলমান গ্রাজুয়েট শেখ রেয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী’র পিতা শেখ মোহাম্মদ ওয়াশিল সিদ্দিকী এ জমি কিনে বাজারটির সংস্কার করেন। তারপর থেকে নাম হয় ‘রেয়াজউদ্দিন বাজার’। কত বড় বাজার! কী পাওয়া যায় না? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব আছে। এখনও ঢুকলে দিক ভুলে যাই। এখনও হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। যেপথ দিয়ে ঢুকব ভেবেছিলাম, ঢুকতে গিয়ে সেপথ হারিয়ে ফেলি। যেপথ দিয়ে বের হবো ভেবেছি, সেপথ আর খুঁজে পাই না। কেমন জানি, গোলক ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাই। একই কথা বক্সিহাটের বেলায়ও প্রযোজ্য। সেসময় একটা গুজব খুব চালু ছিল, বক্সিহাটে কোনো জিনিসের দাম দোকানীরা দ্বিগুণতিনগুণ হাঁকায়। তারপর দরাদরি করে যে যত কম দিয়ে কিনতে পারে, এজন্য অনেকে বক্সিহাটে যেতে চাইত না। ইংরেজ আমলে বাঁশখালির ইলিস্যা গ্রামের বকশি হামিদ বাজারটি বসিয়েছিলেন। বক্সিহাট আমার আছে যতই না আকর্ষণীয় ছিল, তার চেয়ে বেশি ঢের বেশি আকর্ষণীয় ছিল পীতাম্বর শাহ’র দোকান। কথিত আছে, ‘ গুরুর নির্দেশে ১৮০ বছর আগে পীতাম্বর শাহ ঢাকা থেকে পায়ে হেঁটে ১৫২০ দিন পর চট্টগ্রামে পৌঁছেন। চট্টগ্রামে এসে দোকানটি কিনে ব্যবসা শুরু করেন। পরে তাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশেবিদেশে। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো ১৮০ বছর ধরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে তারা একই পদ্ধতিতে একই স্থানে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে দোকানটি পরিচালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির গোড়া পত্তনকারী পীতাম্বর শাহ’র চতুর্থ প্রজন্ম।’ আমার আকষর্ণের কারণ এখানকার পণ্যসামগ্রি। বলা হয়ে থাকে, দুনিয়ায় যা নেই, তাও পীতাম্বর শাহ’র দোকানে পাওয়া যায়। অনেকটা ঢাকার নীলক্ষেতের মতো। বলা হয়, যে বই ছাপা হয়নি, লেখা হয়নি ওটাও নীলক্ষেতে পাওয়া যায়। শুনেছি, গরুর মুত্রগোবর, বাঘের দুধ, বাঘের তেল, হরিণের পিত্ত, এমনকী বেশ্যার বাড়ির মাটিও নাকি এখানে পাওয়া যায়। এসব পণ্য কেন দরকার তা জানি না। সত্যমিথ্যা যাচাইও করিনি। তবে ভেষজ সামগ্রির জন্য এর প্রসিদ্ধি এখনও বর্তমান। ক্রয়বিক্রয় পদ্ধতিতে শত বছরের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছে পীতাম্বর শাহ’র দোকান। এটিকে এ শহরের প্রাচীনতম লোকায়ত ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।

চট্টগ্রামে পতুর্গিজ বণিকরা এখানে থেকে শুল্ক সংগ্রহ করত। এখানেই ছিল তাদের তাড়ৎ। কালক্রমে এটা বাজারে রূপান্তরিত হয়। এখানে ফিরিঙ্গিদের প্রবল আধিপত্য ছিল বলে বাজারটির নামকরণ হয় ‘ফিরিঙ্গি বাজার’। তবে আড়ৎ এখনও আছে। স্টেশান রোড থেকে ফলের আড়ৎ উচ্ছেদ হওয়ার পর এখানে তা স্থানান্তরিত হয়। ‘ফিরিঙ্গি বাজার’ এ শহরের একটি প্রাচীন বাজার। তেমনি আরেকটি প্রাচীন বাজার হলো ‘চকবাজার’। ‘১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হলে কাতালগঞ্জে মোগল প্রশাসনিক দপ্তর ও সদর বাজার স্থাপনের মধ্য দিয়ে শহর চট্টগ্রামের পত্তন হয়। চট্টগ্রামের আঠারশতকের মোগল শাসক নবাব অলি বেগ খাঁ(১৭১৪১৯খ্রি) সদর বাজারের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম চকবাজার রাখেন।’ তবে জানলাম না, কেন এটার নাম চকবাজার করলেন, যেমন জানিনি লালদিঘির পানি লাল নয় কেন? চকবাজার ‘ডেলি লেবার’র প্রসিদ্ধ ছিল। তারা রাস্তার পাশে লাইন ধরে বসত। মানুষ ওদের সঙ্গে দরদাম করে কাজের জন্য নিয়ে যেত। একথা পড়তে গিয়ে অনেকের হয়ত প্রাচীন দাসপ্রথার কথা স্মরণে আসবে।

কাজির দেউড়ি বাজারের নামকরণ হয় ‘বাগদাদ নিবাসী বদি ফাতেমী বংশীয় আরব বণিক সৈয়দ আলফা হোসাইনীর বংশধর কাজি মির আবদুল গণি’র নামানুসারে। এটা ছিল আশির দশকে এ শহরের আধুনিক বাজার। ঐতিহাসিক হামিদুল্লাহ খাঁনের মায়ের নামানুসারে বিবিরহাটের নামকরণ হয়।

অনুমান করা হয়, ব্রিটিশ আমলে লাল খাঁ নামে কোনো এক পুলিশ পাঠান লাল খান বাজার বসিয়েছিলেন। ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে প্রসিদ্ধ পালবাহী জাহাজ নির্মাণের জন্যে স্বনামধন্য ছিলেন ঈশান মিস্ত্রি। হালিশহরের কর্ণফুলী নদীর তীরে তাঁর নামে স্মৃতিস্বরূপ গড়ের ওঠে ঈশান মিস্ত্রির হাট।’ চাঁদগাঁওয়ের রওশন বহদ্দারের নামনুসারে হয়েছে বহদ্দার হাট। ব্রিটিশ আমলের জনৈক কর্ণেলের নামানুসারে কর্ণেল হাট হয়েছে। ‘বাংলার নবাবী আমলে চট্টগ্রামের শাসন কর্তা (১৭৫৩৫৮খ্রি) দেওয়ান মহাসিং দেওয়ান হাট স্থাপন করেন।’ এ শহরে আরও অনেক হাটবাজার বসেছে নানান সময়ে। যেমনকর্ণফুলী বাজার, বউবাজার, ফিশারি ঘাট মাছ বাজার, বাংলা বাজার। এ শহরের এসব হাটবাজারের গোড়াপত্তনের সনতারিখ খুঁজলে হাজার বছরের চট্টগ্রামের মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনকথা স্মরণে আসবে। (তথ্যসূত্র: হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা; দুই পা ফেলিয়া: রামামৃত সিংহ মহাপাত্র)

লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধনবান্ন-আবহমান বাংলার চিরায়ত লোকজ ঐতিহ্যের উৎসব
পরবর্তী নিবন্ধ‘আনন্দ শেয়ার করলে বাড়ে, আর দুঃখ শেয়ার করলে কমে’