আমরা এসব কী দেখছি। নিজবাসভূমে ধর্ষিতা নারীর চিৎকার আর আর্তনাদ। কে শোনে কার কথা। নব বিবাহিতা শিক্ষিত বরবধূ তাদের নিজেদের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল সিলেট শহরে। ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে তারা এসে পৌঁছলো সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মুরারীচাঁদ কলেজের সামনে। আর সেই কলেজের সামনে এসে কুলাঙ্গাররা স্বামীকে চালকের আসন থেকে নামিয়ে গাড়ি চালিয়ে বধূকে নিয়ে গেল ছাত্রাবাসের কক্ষে। স্বামীটিকে দুই কুলাঙ্গার পাহারা দিচ্ছিল আর কয়েক নরপশু মিলে মেয়েটিকে গ্যাং রেপ করলো। এমন ঐতিহ্যবাহী কলেজে ঘটালো জঘন্যতম ঘটনা। এ ঘটনার রেশ না কাটতেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আরেক পাষণ্ড, অশিক্ষিত ও মূর্খ এক জানোয়ার দেলোয়ার এক নারীকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করলো এবং সেই ভিডিও ছেড়ে দিল সবাইকে দেখার জন্য। কি পরিমাণ কুরুচি আর বিকৃত মানসিকতার হলে এমন কাজ করা যায়, তা ভাবতেও রুচিতে আসছে না।
নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্র আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। একটু সুযোগ পেলে নারীর উপর চড়াও হওয়া যেন মুখ্য বিষয় হয়ে উঠে। যে কোন সংকট কিংবা যুদ্ধ বিগ্রহে ও প্রধান টার্গেট থাকে নারী ধর্ষণের বিষয়টি। এটি হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। নারীর শরীরকে নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলা। যার যা ইচ্ছে তাই করে চলেছে। বর্তমানে এর সাথে যুক্ত হয়েছে অত্যন্ত জঘন্য এক মাত্রা। এই দৃশ্য ভিডিও করে তা জনসমক্ষে ছড়িয়ে দেয়া। দেশব্যাপী ডিজিটাল সুবিধা এবং অবাধ তথ্যপ্রবাহের কারণে বিশ্ব এখন সকলের হাতে ও মুঠোয়। এর সুফলও আমরা পাচ্ছি। কিন্তু একটু গভীরে খতিয়ে দেখলে আমরা কি দেখি, কিশোর, তরুণ যুব সমাজ এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করছে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে। আমি শুধু আমার এলাকার কথায় যদি বলি বস্তির ছোট ছোট কিশোর যুবক আবাল প্রত্যেকের হাতে রয়েছে একটি অথবা দুটি করে মোবাইল। এরা কেউ শিক্ষিত না। এরা কেউ মাছ ওয়ালার ছেলে নতুবা তরকারিওয়ালার ছেলে। সন্ধ্যার পর থেকে এরা দলবদ্ধ হয়ে মোবাইলে বুদ হয়ে থাকে। তারা মোবাইলে টিপ দিলেই পেয়ে যাচ্ছে যাবতীয় পর্নোগ্রাফি, সেঙুয়াল যা কিছু আছে তার সবই। কাজেই তাদের কাছে তা বিনা পয়সায় এক বিরাট জগতের পাওনা। তো তারা আর একটু সুযোগ পেলে কি করবে? ইভ টিজিং করবে, ছিনতাই করবে আর গ্যাং রেপ করবে।
আমাদের দেশে তথ্য প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করেছে মানুষকে বিশ্বায়নের সাথে সংযুক্ত করার মানসে। কিন্তু, যেখানে শিক্ষার অভাব, আবার যারা শিক্ষিত আছেন তাদের মাঝে রয়েছে নৈতিকতার চরম অভাব। ফলে এই প্রযুক্তির যেটি ইতিবাচক দিক তার সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। আর নেতিবাচক দিক নিয়ে নগ্ন খেলায় রাতদিন মেতে থাকে কিশোর যুবা আবাল বৃদ্ধ সকলেই। এতে করে যুবক আর কিশোর সমাজ এখন ধ্বংসের পথে। এই অবস্থা থেকে কিভাবে এদের ফেরানো যায় এটি এখন সময়ের দাবি। এটি হলো প্রথম প্রস্তাবনা। আর দ্বিতীয় প্রস্তাবনা হলো আইন, কঠোর আইন থাকতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, “নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতন বন্ধের জন্য আমাদের একাধিক আইন রয়েছে। আইনে অত্যন্ত কঠোর শাস্তির বিধানও রয়েছে। আলাদা বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনালের ব্যবস্থাও আছে। এতকিছু সত্ত্বেও ধর্ষকদের ভীত করা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন তারা ধর্ষনের ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। এতে করে এটি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বর্তমান আইনি কাঠামো ধর্ষণ দমনে কার্যকর হচ্ছে না। এর বিচারের জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।”
অর্থাৎ সেই মান্ধাতার আমলের আইন দিয়ে চলবে না। নমুনা সংগ্রহ, পরীক্ষা নিরীক্ষা, ধর্ষিতার ভাষ্য গ্রহণ, একবার থানায় নেয়া আবার কোর্টে নেয়া এসব কি? নারীটি তার সম্ভ্রম তো হারালো, সে যে ধর্ষিতা হলো তা তো তার মুখের কথায় স্পষ্ট। এসব আইন দিয়ে তাকে আবার হেনস্থা করার কোন মানে হয় না। ধর্ষণকারীর বিচার হতে হবে অত্যন্ত দ্রুত। এর জন্য কোন থাানা পুলিশ উকিল নাজির দরকার নেই।বিশেষ এক ট্রাইব্যুনালে এর বিচার হতে হবে। আমাদের দেশে যে আইন আছে তার প্রয়োগ নেই। এই অবস্থায় রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আইনি ব্যাপারটাকে অত্যন্ত কঠোর করতে হবে। আমাদের দেশে যে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আছে সেখানে ধর্ষণের বিষয়টিকে নিয়ে আলাদা একটি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা করা জরুরি। এটাকে জোরালো ও কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সাজা হাল্কা পাতলা করার কোন সুযোগ থাকতে পারবে না। মার্শাল ল’ এর মতো দেখা মাত্র গুলির নির্দেশের মতো তাদের অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। তবে মূল কথা হলো যারা বিচার করবেন সেখানেও রয়েছে পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য। এই বিচারিক ব্যবস্থাপানায় আইনজীবী ও বিচারপতি নারীদের নিয়োগ দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক