এ আত্মহননের দায় কে নেবে

পংকজ দেব অপু | সোমবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

মাত্র সাড়ে পাঁচ লাইনের একটি চিরকূটআমাদের ভাবনার জগতকে একেবারে ওলটপালট করে দিলো। দিনাজপুর বোর্ডের ফুলবাড়ীস্থ শহীদ স্মৃতি আদর্শ কলেজের মানবিক বিভাগের এবারের এইচ.এস.সি পরীক্ষার্থী জিহাদ হাসান চিরকূটে লিখেছে “আমি জানি না কীভাবে এতো খারাপ ফলাফল হলো আমার। আমি পারব না এতো খারাপ রেজাল্ট নিয়ে তোমাদের সামনে দাঁড়াতে। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও আব্বু ও আম্মু। আমার জন্য তোমাদের অনেক সম্মান গেছে। আমাকে ক্ষমা করে দিও সকলে। আমি তোমাদের আশাভরসা স্বপ্ন কোনো কিছুর যোগ্য হতে পারলাম না। কেন এমন হৃদয় বিদারক কথাগুলো লিখতে হল জিহাদকে? জিহাদ ৭টি বিষয়ের ৬টি তে অ+ পেয়েছে। ইংরেজি বিষয়ে তার গ্রেড ঋ অর্থাৎ সে এই বিষয়ে ফেল করেছে। বয়:সন্ধিক্ষণের প্রচন্ড আবেগ নিজেকে ধরে রাখতে না পারায় স্বাভাবিক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পৃথিবী থেকে নিজের অস্তিত্ব মুছে দেয়ার সংকল্প নিয়ে ফেললো সে। কেন একজন সম্ভাবনাময় তরুণ এভাবে নিজেকে নিঃশেষ করে দিলো এর দায় কে নেবে? আমাদের এক সহকর্মীর কৌতূহলসবকটাতেই অ+, একটাতে ফেল, এটা কি মারাত্মক অসংগতি নয়! শিক্ষাবোর্ডে যারা ফলাফল তৈরিতে নিয়োজিত, তাদের হয়তো এটা নজর এড়ায়নি, কিন্তু উত্তরপত্র যেহেতু তারা মূল্যায়ন করেননি, তাদেরই বা এ দায় কীসের? ইংরেজি বিষয়ের যাঁরা পরীক্ষক ছিলেন তাঁরা হয়তো বা বলবেন, যতটুকু প্রাপ্য তাই তাঁরা দিয়েছেন। অন্যের উপর দোষ চাপানোর সংস্কৃতি থেকে বের না হয়ে আসাতে না পারার কারণে অপকর্ম করেও আমরা সহজেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি, একথা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?

দৈনিক আজাদী ৯ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার প্রথম পাতায় শিরোনাম করেছে ‘ইংরেজির কারণেই পিছিয়ে চট্টগ্রাম’ সারাদেশের গড় পাস ৮৫.৯৫% হলেও চট্টগ্রামে পাসের হার ৮০.৫০%। চট্টগ্রাম পিছিয়ে আছে ৫%। এটা নির্দ্বিধায় স্বীকার করে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ বলেছেনপার্বত্য অঞ্চল ও দ্বীপ অঞ্চলে অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকায় ইংরেজিতে এমন বিপর্যয়। ইংরেজির কারণেই ৯ শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অবস্থান ৭ম। এটাই কি একমাত্র কারণ? অনার্স কলেজের ইংরেজি বিষয়ের একজন সম্মানিত অধ্যাপক এ প্রসঙ্গেঁ বলেছেন ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের প্রশ্ন কঠিন হয়েছে। অত্যন্ত বিনয়ের সংগে ইংরেজি বিষয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের প্রশ্ন করতে চাইকঠিন প্রশ্ন কি একান্তই জরুরী? এখানে পাণ্ডিত্য না দেখালেই কি নয়? এ প্রসঙ্গেঁ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাংলার বাঘখ্যাত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথায় বর্ণিত একটি ঘটনা স্মর্তব্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অংকের শিক্ষক এসেছেন তাঁর কাছে প্রশ্নপত্র জমা দিতে। প্রশ্ন দেখে তার চোখ তো ছানা বড়া। তিনি বিস্ময় লুকিয়ে শিক্ষক মহোদয়কে বললেনআমি একটু বাইরে যাচ্ছি। এই ফাঁকে আপনি অংকগুলোর সমাধান করতে থাকুন। ৪০ মিনিট পর উপাচার্য মহোদয় এসে দেখলেন অংকের উত্তর মেলাতে শিক্ষক একেবারে গলদঘর্ম। তারপর অংকের শিক্ষককে তিনি বললেনদেখুন, আপনারা যা নিজেই পারেন না, কীভাবে আশা করেন কোমলমতি শিক্ষার্থীরা সেটা করতে পারবে?

মেধাবী শিক্ষার্থীরা বাকি বিষয়গুলোতে অ+ পেয়েও ইংরেজির কারণে ভালো গ্রেড থেকে বঞ্চিতই শুধু হয়নি, বিশেষ করে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেই অংশ নেয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। তাদের অধিকাংশই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে ভর্তি কোচিংয়ে যুক্ত হয়েছে হাজার হাজার টাকা দিয়ে। অভিভাবকদের কষ্টার্জিত অর্থের ওখানেই জলাঞ্জলি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের বীজ যে অংকুরেই বিনষ্ট হল, তার দায় কে নেবে?

প্রশ্নপত্রের কথা তো আগেই বলেছি। এবার বলি উত্তরপত্র মূল্যায়নের কথা। শিক্ষাবোর্ড প্রতিবারই পরীক্ষকদের ২০ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে ঙগজ বোর্ডে জমা দিতে সময় বেঁধে দেন। ৩০০ উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে যেখানে ১৫ দিন লাগার কথা, সেখানে ১০০০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত উত্তরপত্র প্রদান করে তাদের উপর মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টি করা হয়। উত্তরপত্র কাটাই শুধু নয়, শিক্ষকদের করতে হয় টপ শীটে নম্বর তুলে বৃত্তভরাটের ঝুঁকিপূর্ণ কাজটিও। চতুর্মুখী চাপের কারণে শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই ভুল করেন আর তার নিষ্ঠুর শিকার হন আমাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, কিছু সম্মানিত শিক্ষক বোর্ডের কতিপয় অসাধু কর্মচারীর সহায়তায় ১৫০০ পর্যন্ত উত্তরপত্র গ্রহণ করেন অতিরিক্ত রোজগারের আশায়। তাঁরা ভুলে যান খাতা মূল্যায়ন তাদের দৈনন্দিন কর্ম হলেও শিক্ষার্থীর কাছে এটা জীবনমরণ সমস্যা। তাতে একটু নড়চড় হলেই শিক্ষার্থীরা হতাশার অতল গহ্বরে নিপতিত হয়। তিলে তিলে গড়ে তোলা সাধনালব্ধ ফলাফল যদি শিক্ষকের গাফেলতির কারণে নষ্ট হয়ে যায়, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?

শিক্ষাবোর্ডকে ভাবতে হবে, তাড়াহুড়ার ফল কখনো ভালো হয় না। উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। সম্মানিত শিক্ষকদেরও অতিরিক্ত রোজগারের কথা বাদ দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়নে আরও আন্তরিক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, তিনি শুধু পরীক্ষক নন, একজন দায়িত্বশীল অভিভাবকও। তবেই আমাদের প্রিয় শিক্ষার্থীরা হতাশার চোরাবালি থেকে মুক্তি পাবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ,

নানুপুর লায়লা কবির কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদ সড়কের স্বপ্ন পূরণ হবে কবে?
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক খিঁচুনি দিবস : কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান