ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগের সূচনা লগ্নে অন্যতম দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র হলো স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (এস টি কোলরিজ) ও উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ। এ দুজনের যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত “লিরিক্যাল ব্যালাডস” (Lyrical Ballads ) এর মাধ্যমে ইংরেজি রোমান্টিসিজমের (কল্পনা বিলাসী ভাবধারা) যাত্রা শুরু হয়। রোমান্টিক আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো প্রকৃতিপ্রেম, অনুভূতির মুক্তি, কল্পনার বিকাশ, মানবিক চেতনা এবং রোমাঞ্চ বোধ। এ ভাবধারার মধ্য দিয়েই কোলরিজ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অতিপ্রাকৃত ধারার প্রধান কবি হিসেবে। আধুনিক রোমান্টিকতার ভিত তৈরীতে কোলরিজ এবং ওয়াডসওয়ার্থ’ এর অবদান থাকলেও তাঁদের চিন্তা ভাবনা, সৃজনশীলতা এবং কাব্য রীতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। কোলরিজের কবিতায় অতিপ্রাকৃত উপাদান, রহস্যময় ঘটনা বিন্যাস, অদ্ভুত অতিপ্রাকৃত স্বপ্ন, অলৌকিক ঘটনার বিন্যাস – সব মিলিয়ে এক বিস্ময়কর কল্পলোক সৃষ্টির প্রয়াস খুঁজে পাওয়া যায়। কোলরিজের কাব্যিক প্রকাশের মূলে ছিল অতিপ্রাকৃত ভাবধারা, মানব চেতনার রহস্য এবং কল্পনার অলৌকিক শক্তির বিন্যাস। তিনি ছিলেন রোমান্টিক যুগের আধ্যাত্মিক কবি যিনি মানব হৃদয়ের অন্তর্নিবিষ্ট কল্পনা, সৃজনশক্তি ও অস্তিত্বের রহস্যময়তা গভীরভাবে অনুসন্ধান করেছেন। তাঁর মতে কবিতা শুধু অনুভূতির প্রকাশ নয়, বরং মনের সৃজনশীল শক্তির বহিঃপ্রকাশ। রোমান্টিকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য যদিও কল্পনাবিলাস কিন্তু কোলরিজের এ কল্পনা এসে মিশে গিয়েছিল অতিপ্রাকৃত ভাবধারার মাঝে। তাঁর মতে কবিতার লক্ষ্য হলো এমন এক কাব্যরস ধারা সৃষ্টি করা যেখানে বাস্তবতা ও কল্পনা মিশে গেছে এক অনন্য স্রোতধারায়। তিনি এমনভাবে অতিপ্রাকৃত পরিবেশ সৃজন করেছেন যেখানে পাঠক বর্ণিত সকল বিষয় সত্য বলে ধরে নিয়েছেন। এটা তাঁর মতে পাঠকের স্বেচ্ছায় অবিশ্বাস স্থগিত করাকে (Willing suspension of disbelief ) বোঝায়। ফলে অবাস্তব, অসম্ভব কোনো ঘটনা পাঠকের মনোমন্দিরে বাস্তব এবং সম্ভব বলে মনে হতো।
অন্যদিকে ওয়াডসওয়ার্থ’র কবিতায় ছিল প্রকৃতির বাস্তবানুগ প্রকাশ যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনবোধ, প্রকৃতির যথার্থ বর্ণনা ও শিক্ষা এবং মানুষের অন্তর্লোককে বাস্তবতার নিরিখে উপস্থাপন করার প্রয়াস। কাজেই একই রোমান্টিক ভাবধারায় উদ্দীপ্ত দুই প্রধান কবির কাব্য ভুবনে মৌলিক পার্থক্য সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কবিতার মাধ্যমে পাঠককে বাস্তবরূপ থেকে সাময়িকভাবে বিস্ময়, রহস্য, ভীতি ও কল্পনার উচ্চ স্তরে অবগাহন করার ধারণাতে ছিল কোলরিজের প্রগাঢ় বিশ্বাস। কোলরিজের অতিপ্রাকৃতবাদ তিনটি মূল বৈশিষ্টের ওপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, যেমন স্বপ্নময় রহস্যাবৃত পরিবেশ সৃষ্টি, অদৃশ্য বা অলৌকিক শক্তি বা চরিত্রের উপস্থিতি এবং মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতি, অপরাধবোধ বা আত্মিক যন্ত্রণার নিবিড় অনুসন্ধান।
“দি রাইম অফ এনসেয়েন্ট ম্যারিনার (The Rime of Ancient Mariner ) কবিতায় কোলরিজের অতিপ্রাকৃতবাদের শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে সমুদ্র যাত্রায় বিড়ম্বনা ও ভয়াবহতা, অলৌকিক শক্তির সন্নিবেশ, মানুষ ও প্রকৃতির রহস্যময় প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। বৃদ্ধ নাবিক কর্তৃক অকারণে আলবাট্রস পাখি হত্যা এক নিদারুণ নিষ্ঠুর অভিশাপ ডেকে এনেছিল। জাহাজের অচলাবস্থায় তৃষ্ণা ও খাদ্যাভাবে প্রায় ২০০ নাবিকের মৃত্যু এবং বৃদ্ধ নাবিকের অন্তর্দাহ পরবর্তী নরকযন্ত্রণাসম নি:সঙ্গতা বাস্তবের অতীত এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। নাবিকদের অসহনীয় মৃত্যু এবং বৃদ্ধ নাবিকের মানসিক মৃত্যু যন্ত্রণার প্রেক্ষিতে জাহাজে জীবন ও জীবনমৃত্যুর পাশাখেলা দৃশ্যেরঅদৃশ্য ভয়াবহতা (Spirits and Life in Death ) মানব জগতে যেন এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। যন্ত্রণাক্লিষ্ট নাবিকদের মৃত্যুর পর দেহ নাড়ানো অবস্থায় জাহাজ চলার বিষয়টিও অলৌকিক শক্তির ভয়াবহ রূপ। প্রাকৃতিক নিয়মে ঘটলেও বৃদ্ধ নাবিকের অপরাধবোধ তাঁর অনেক মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছিল যা প্রকৃতির মাঝে অতিপ্রাকৃত হলেও স্বাভাবিক শাস্তিস্বরূপ।
অতিপ্রাকৃতবাদ নিয়ে কোলরিজের অপর একটি কবিতা হচ্ছে ক্রিস্টাবেল (Christabel ) যেখানে জেরালডাইন (Geraldine ) নামক রহস্যময় নারীর অবাস্তব ও অলৌকিক উপস্থিতি রয়েছে। ক্রিস্টাবেলের ওপর মানসিক নিয়ন্ত্রণ – অন্ধকার এক ভৌতিক পরিবেশ, এসব ঘটনার দৃশ্য কবিতাটিকে গভীর রহস্যময়তায় ভরিয়ে তুলেছিল। জেরালডাইনের অস্বাভাবিক আচরণ, তাঁর শারীরিক বর্ণনা এবং তাঁর অদৃশ্য ক্ষমতা পাঠক মনে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এ কবিতায় কোলরিজ মানব মনের ভয়, সন্দেহের সাথে অলৌকিক শক্তির দ্বন্দ্বকে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
“কুবলা খান” (Kubla Khan ) কোলরিজের অন্যতম রহস্যময় কবিতা যেটি তিনি আফিম সেবন জনিত স্বপ্নঘোরে রচনা করেন। এখানে তাঁর অতিপ্রাকৃতবাদ ধারণা প্রকাশ পেয়েছে স্বপ্নময় এক ভৌগোলিক পরিবেশে যেখানে রবি কিরণ বিহীন সাগর ” পধাবৎহং সবধংঁৎবষবংং ঃড় সধহ” ইত্যাদির বর্ণনায়। এ কবিতায় তাঁর অসীম কল্পনা শক্তির প্রকাশ ঘটেছে প্রকৃতি ও মানুষের অদৃশ্য মিলন শক্তির সংমিশ্রণে। “উধসংবষ রিঃয ধ ফঁষপরসবৎ ” এর উপস্থিতি যেন এক অতিলৌকিক সংগীতের প্রতীক। পুরো কবিতা জুড়ে রহস্য, অনুভূতি, স্বপ্ন ও অদৃশ্য সৌন্দর্যের মিলন যা অতিপ্রাকৃতবাদকে নতুন মাত্রায় প্রকাশ করেছে। কোলরিজের কবিতার বিষয়বস্তু নিহিত ছিল অতিপ্রাকৃত বা অপ্রাকৃতবাদ, রহস্য, কল্পনা, মনস্তত্ব ও ভৌতিকতায়। ওয়াডসওয়ার্থ কল্পনা ব্যবহার করেছেন কবিতাকে বাস্তব, পবিত্র, প্রাণবন্ত, মহিমান্বিত ও মানবিক করে তোলার জন্য। কোলরিজ কবিতায় কল্পনাকে ব্যবহার করেছেন অবাস্তবকে বাস্তবের মতো করে তুলতে।স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের কাছে প্রকৃতি ছিল কখনো ভয়ংকর, কখনো রহস্যময় কিংবা অতিপ্রাকৃত শক্তির বাহনরূপ। তাঁর কবিতায় ও চিন্তা চেতনায় ছিল মানব মনের আতঙ্ক, অপরাধবোধ, স্বপ্ন ও মানসিক অস্থিরতার দোলাচল। মূলত তিনি রোমান্টিকতায় অতিপ্রাকৃতবাদকে কবিতার ভিত হিসেবে প্রকাশ করেছেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক যুগে অতিপ্রাকৃতবাদকে এক অনন্য শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় কল্পনা, রহস্য, স্বপ্ন, অতিলৌকিক শক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এক অভিনব কাব্যজগত যা রোমান্টিক কবিতায় নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল।
অন্যদিকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির মাঝে বাস্তবের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন সহজ, সরল, প্রাণবন্ত প্রকাশের মাধ্যমে। উভয়ই একই যুগের প্রতিনিধিত্বশীল কবি হলেও ভিন্নধর্মী মতাদর্শ তাদেরকে একের কাছ থেকে অন্যকে পৃথকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের ‘দি রাইম অফ এন্সেন্ট ম্যারিনার’, ‘কুবলা খান’ ও ‘ডিজেকশন’ কবিতাগুলো ইংরেজি সাহিত্যে অতিপ্রাকৃতবাদের অনন্য সৃষ্টি। মানুষের নৈতিক অবক্ষয় কিভাবে মানুষকে অতিপ্রাকৃত সংকটে ফেলে ‘দি রাইম অফ এন্সেন্ট ম্যারিনার ‘ কবিতায় তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে। ‘ কুবলা খান ‘ কোলরিজের অর্ধেক স্বপ্নে পাওয়া কবিতা পুরোপুরি রহস্যময়, চিনামাটির প্রাসাদ জানাডুর অলৌকিক সৌন্দর্য, আনন্দের প্রাসাদ অমানবিক গাম্ভীর্যপুর্ণ যেখানে অতিপ্রাকৃত রহস্যই স্বপ্নের বহিঃপ্রকাশ। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ‘এর কবিতা প্রকৃতি প্রেম, মমত্ববোধ ও মানবিকতার মূর্ত প্রতীক। অতিপ্রাকৃত ভাবধারার আলোকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত হলেও কোলরিজের সৃষ্ট কর্ম রোমান্টিক কবিতাকে করেছে ঋদ্ধ, বৈচিত্র্যময়, চিরন্তন ও প্রাসঙ্গিক।
স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ তাঁর কবিতায় অতিপ্রাকৃত উপাদানকে শুধুমাত্র অলৌকিক বিস্ময়রূপে দেখেননি বরং মানব মনের গভীরতম অনুভূতি, অজ্ঞাত ভয়ের স্পন্দন এবং কল্পনার অবাধ যাত্রাকে সুন্দরভাবে রূপ দিতে এক অনন্য কাব্যভুবন নির্মাণ করেছেন। তাঁর কবিতায় অতিপ্রাকৃতের উপস্থিতি পাঠককে বাস্তবতার বাইরে টেনে নিয়ে যায়, আবার সেই রহস্যময়তার ভেতর দিয়ে মানবচেতনার সত্যিকারের প্রতিচ্ছবি উন্মোচিত হয়। “দ্যা রাইম অফ দ্যা আন্সেন্ট ম্যারিনারসহ বিভিন্ন কবিতায় অলৌকিকতা কখনো ভয়ঙ্কর, কখনো মোহময় আবার কখনো নৈতিক শিক্ষার স্বরূপ বিধৃত হয়েছে। কোলরিজ দেখিয়েছেন কল্পনা কেবল মনের খেয়াল নয়, বরং এটি মানুষের আত্মার গভীরতম সত্যে পৌঁছানোর এক সৃজনশীল মাধ্যম। তাই তাঁর অতিপ্রাকৃতবাদ শুধুমাত্র কাহিনির অলৌকিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল না – এটি মানব মনের রহস্য, নৈতিক দ্বন্দ্ব, পাপ ও মুক্তির চিরায়ত সন্ধান। তাঁর কাব্যপ্রতিভার এই অনন্য বৈশিষ্ট্যই তাঁকে রোমান্টিক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং অতিপ্রাকৃত কাব্যের অসামান্য রূপকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
লেখক: শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ ও বর্তমানে রেক্টর, বনফুল আদিবাসী গ্রীনহার্ট কলেজ










