১. এইচএসসিতে বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি বই NCTB কর্তৃক প্রণীত হয়। বাজারে প্রচলিত অনুমোদনহীন অনেকগুলো আইসিটি বই থাকলেও সরকারীভাবে নির্দেশনা রয়েছে শুধু ঘঈঞই প্রণীত বই হতে পাঠদান করানোর এবং প্রশ্ন করার। এক্ষেত্রে উক্ত বইয়ের বাহির হতে কোনো প্রশ্ন আসলে তা সিলেবাস বহির্ভূত হিসেবে গণ্য হয় এবং বোর্ড কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের উক্ত প্রশ্নের অটো নম্বর দিতে সিদ্ধান্ত নেয় বা দেয়।
২. NCTB কর্তৃক প্রণীত সিলেবাস অনুসারে রচিত এবং অনুমোদিত অন্যান্য বইগুলোর অনুমোদিত নির্ধারিত পৃষ্ঠার বই স্ট্যান্ডার্ড ধরে কলেজে পাঠদান করানো এবং উক্ত বইগুলোর ভিতর হতে প্রশ্ন প্রণয়ন করা নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপন জারি করা প্রয়োজন। অনুমোদিত বইগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা কম থাকায় (২৫০ হতে ৩০০ পৃষ্ঠা) একজন শিক্ষার্থী প্রতি বিষয়ের একাধিক বই কিনে পড়তে পারবে। অনুমোদনহীন সিলেবাস বহির্ভূত টপিক বা পৃষ্ঠা তাকে পড়তে হবে না। সেক্ষেত্রে নির্ধারিত সিলেবাস শেষ হবে এবং শিক্ষার্থী অধিক অনুশীলন করার সময় পাবে, শিখন স্থায়ী এবং দৃঢ় হবে।
৩. NCTB নির্দেশনা অনুযায়ী রচিত ও অনুমোদিত অন্যান্য বইগুলো ২৫০–৩০০ পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার নির্দেশনা থাকলেও বাজারের প্রচলিত বইগুলো ৭০০–৮০০ পৃষ্ঠা, যা শিক্ষার্থীদের উপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে। উপরন্তু বাজারে প্রতিটি বিষয়ের উপর ৭ হতে ১০টি NCTB কর্তৃক অনুমোদিত বই রয়েছে। যেহেতু অধিকাংশ বিষয়ে MCQ উত্তর করতে হয়, তাই অতিরিক্ত বই এবং নির্ধারিত পৃষ্ঠার অতিরিক্ত পাঠ শিক্ষার্থীদের সময়ের তুলনায় অসহায় করে তুলছে।
৪. উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষায় মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে। পরবর্তী বছরে এইচএসসির সকল বইয়ে উক্ত প্রশ্নের কনটেন্ট বা উত্তর সংযোজন করে প্রকাশনাগুলো নতুন বই বাজারজাত করে, এতে করে বইগুলো অযথা বড় হচ্ছে (অনুমোদিত বইগুলো ২৫০ হতে ৩০০ পৃষ্ঠা এবং বাজারে প্রচলিত উক্ত বইগুলো ৭০০ হতে ৮০০ পৃষ্ঠা)। মনে রাখতে হবে, উচ্চ মাধ্যমিক বইগুলো মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এর ভর্তি গাইড নয়।
৫. প্রতি তিন বছর পর পর NCTB হতে অনুমোদিত বইগুলো পূনঃঅনুমোদন নিতে হয় বা করতে হয়। NCTB যথারীতি ২৫০ হতে ৩০০ পৃষ্ঠার বইগুলো পূনঃঅনুমোদন করে। কিন্তু বাজারে অনুমোদিত বইগুলো পাওয়া যায় না, উক্ত বইগুলোর পরিবর্তে ৭০০–৮০০ পৃষ্ঠার বই প্রচলিত রয়েছে। এক্ষেত্রে NCTB এবং শিক্ষাবোর্ড যদি আইসিটি বিষয়ের মত (NCTB কর্তৃক প্রণীত) ঘোষণা করে যে, শুধু অনুমোদিত নির্ধারিত পৃষ্ঠার বই হতে প্রশ্ন হবে। বাহির হতে কোনো প্রশ্ন করা হবে না এবং তা সিলেবাস বহির্ভূত হিসেবে গণ্য হবে। তাহলে কারিকুলাম ও সিলেবাস বহির্ভূত লেখা অতিরিক্ত পৃষ্ঠার বইগুলো শিক্ষার্থীরা কিনে প্রতারিত হতো না বা অযথা মানসিক চাপে পড়ত না।
৬. কারিকুলাম ২০১২ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল। তখন সাপ্তাহিক ছুটি একদিন (শুধু শুক্রবার) ছিল। বর্তমানে শুক্রবার ও শনিবার সপ্তাহে দুইদিন। নবম ও দশম শ্রেণিতে দুইবছরে ১০৪টি শনিবার এর মধ্যে প্রায় ১০০টি শনিবার পূর্বে খোলা এবং পাঠদান চললেও বর্তমানে তা বন্ধ থাকছে। এক্ষেত্রে সিলেবাস শেষ করা এবং তা শিক্ষার্থীদের আয়ত্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
অনুরূপ, এইচএসসিতে প্রায় ২১ মাস ক্লাস চলে, সেক্ষেত্রে প্রায় ৮৪টি শনিবার শ্রেণি কার্যক্রম পূর্বে চালু থাকলেও বর্তমানে বন্ধ থাকছে। উচ্চমাধ্যমিকের এত বড় সিলেবাস পূর্ণরূপে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে সিলেবাস শেষ করতে হচ্ছে। যা শিক্ষার্থীদের নিকট বোধগম্য হচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীরা স্কুল/কলেজ বিমুখ হচ্ছে বা কোচিং সেন্টারের দ্বারস্থ হচ্ছে।
৭. পূর্বের সিলেবাস, পূর্বের মানবণ্টন, পূর্বের প্রশ্ন প্যাটার্ন ঠিক রেখে নবম–দশম শ্রেণিতে প্রায় ১০০টি এবং একাদশ–দ্বাদশ শ্রেণিতে ৮৪টি শনিবার শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ রেখে পাঠদান ও পরীক্ষা নেওয়া, শিক্ষার্থীদের উপর এত বড় সিলেবাসের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি চরম গোজামিল এবং এক ধরনের প্রতারণা।
এসএসসি/এইচএসসি ফলাফল বিপর্যয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করা হলেও আলোচ্য বিষয়গুলো কোনো শিক্ষাবিদ, শিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষামন্ত্রণালয় এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এমনকি যারা শিক্ষা বিষয়ক সংবাদ প্রচার করেন, তারা কেউ অনুধাবন করেননি বা তাদের ধারণায় আসেনি।
৮. ২০২৫ সালে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে হয়েছিল, তারপরও ফলাফল বিপর্যয় হয়েছে। ২০২৬ সালে এত অল্প সময়ে সিলেবাস শেষ করে সম্পূর্ণ সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ আরও বিপর্যস্ত করে তুলবে। ইতোমধ্যে শিক্ষাবোর্ড ঘোষণা দিয়েছে ২০২৬ সালের মে/জুন মাসে পূর্ণ সিলেবাসে এইচএসসি পরীক্ষা নিবে। ২০২৪ সালে আন্দোলন পরবর্তী ১১ আগস্ট হতে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হলেও পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় সম্পূর্ণ সিলেবাস শেষ করা কঠিন হবে। উপরন্তু ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা রয়েছে।
৯. ২০২০ সালে কোভিড পরবর্তীতে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া হলেও বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে তা মোটেও সংক্ষিপ্ত বলা যায় না। NCTB অনুমোদিত সিলেবাস ও বইয়ের পৃষ্ঠা হতে অনেক বেশি।
১০. ২০১৯ বা তার পূর্বে এইচএসসি সেশনের ক্লাস ১লা জুলাই শুরু হতো এবং ১লা এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে তা মে মাস পর্যন্ত বা রমজান এর পূর্বে শেষ হতো। ২০১৯ সালের উচ্চমাধ্যমিক রুটিন অনুযায়ী ১লা এপ্রিল পরীক্ষা শুরু এবং ১১ মে পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। তখন শিক্ষার্থীরা শ্রেণি কার্যক্রম ও সিলেবাস শেষ করার জন্য অধিক সময় পেত। বর্তমানে রোজা এবং কুরবানি ঈদের পর পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, এতে করে সময় পূর্বের মত ২০ বা ২১ মাস হিসেব করলেও রমজান এর কারণে শ্রেণি কার্যক্রম কম হচ্ছে। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং এইচএসসি পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যেহেতু রোজা রাখে, তাদের সিলেবাস শেষ করা কঠিন হচ্ছে বা সারাদিন রোজা রেখে পাঠে মনোনিবেশ করতে পারছে না।
লেখক: অধ্যক্ষ, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, চট্টগ্রাম, বাংলা ও ইংরেজি ভার্সনে প্রাক–প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে একাধিক বইয়ের রচয়িতা












