এল নিনো ও লা নিনা

রিয়াজুল হক | বুধবার , ১৫ নভেম্বর, ২০২৩ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই এ বছর হাসফাঁস গরমে কীভাবে নাকাল হয়েছি সবাই। বর্ষার আগমন এবং প্রস্থান দেরিতে হওয়া এবং বেশি গরম অনুভূত হওয়ার কথা নিশ্চয়ই তোমাদের মনে আছে? কেউ কী বলতে পারো কেন হয়েছে এমন অবস্থা? ঠিকই বলেছো, এল নিনোর কারণে এই অবস্থা হয়েছে। লা নিনাও কিন্তু কখনও কখনও আবহাওয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা তৈরি করে। তোমাদের হয়তো মনে হতে পারে এই জমজ বোন দু’জন কোন দেশের, দেখতে তারা কেমন, কোন ভাষায় কথা বলে তারা, তাই না? আসলে এল নিনো আর লা নিনা জলবায়ুর দু’টি বিপরীতধর্মী অবস্থা যা স্বাভাবিক অবস্থার ব্যতিক্রম। এল নিনোর কারণে সারা পৃথিবীর আবহাওয়াই অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

স্বাভাবিক অবস্থায় পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের বায়ু নিরক্ষরেখা বরাবর পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। ফলে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে উষ্ণ পানি এশিয়ার দিকে বয়ে যায়। সেই উষ্ণ পানি প্রতিস্থাপন করার জন্য সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল পানি উপরে উঠে আসে। তাই স্বাভাবিক সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব ভাগের পানির তাপমাত্রা পশ্চিমাঞ্চল থেকে বেশ কম থাকে। তাই ইকুয়েডর, পেরু, উত্তর চিলি ইত্যাদি পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগীয় উপকূল থেকে প্রায় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। এছাড়াও পূর্ব থেকে যখন পশ্চিমে বায়ু প্রবাহিত হয় তখন সেই বায়ু সূর্যের তাপে উত্তপ্ত হয়। এ কারণেও মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চলে পানির তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে কিন্তু এল নিনোর সময় পুরো প্রক্রিয়াটি বিপরীতভাবে ঘটে। পূর্বের দিকে গরম বায়ু প্রবাহিত হতে থাকে।

এটি কেন হয় তোমাদের জানতে হচ্ছে করছে নিশ্চয়ই। তাহলে শোনোগ্রীষ্ম প্রধান পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যখন সাধারণ গড় তাপমাত্রা থেকে ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায় তখন এল নিনো অবস্থার সৃষ্টি হয়। আর এর ফলাফল তো তোমরা দেখেছোই। কিছু কিছু বিশেষজ্ঞের মতে এল নিনোর প্রভাবে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলাফল হচ্ছে সমৃদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, অতি বৃষ্টি, খরা, বন্যা ইত্যাদি।

স্প্যানিশ ভাষায় এল নিনোএর মানে হচ্ছে ছোট ছেলে এবং লা নিনাএর মানে হচ্ছে ছোট মেয়ে। তোমাদের নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে কারা প্রথম এই নামটি ব্যবহার করেছিল। ঠিকই ধরেছো, দক্ষিণ আমেরিকার জেলেরা।

তারা প্রথম ১,৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রশান্ত মহাসাগরে অস্বাভাবিকভাবে উষ্ণ পানির সময়কাল লক্ষ্য করেছিলেন। তারা যে পুরো নামটি ব্যবহার করেছিল তা ছিল এল নিনো দে নাভিদাদ কারণ এল নিনো সাধারণত ডিসেম্বরে ক্রিস্টমাসের সময় শুরু হয়। তোমরা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছো জেলেরা কীভাবে এল নিনো ঘটনাটি বুঝতে পেরেছিল।

তাহলে শোনো, এল নিনো’র প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলের সামুদ্র্রিক জীবনের ওপরও শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থার সময় যখন সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল পানি সমুদ্রপৃষ্ঠে নিয়ে আসে তখন এই শীতল পানি ফাইটোপ্লাঙ্কটন সমৃদ্ধ থাকে। এই ফাইটোপ্লাঙ্কটন খেতে অনেক অ্যাংকভি মাছ সমুদ্র উপকূলে আসে এবং সেখানকার জেলেরা সেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে কিন্তু এল নিনো’র সময় শীতল পানি সমুদ্রপৃষ্ঠে কম উঠে আসে বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সমুদ্র উপকূলে কম ফাইটোপ্লাঙ্কটন থাকে। আর মাছ সেই এলাকা এড়িয়ে চলে। জেলেদের জালে আর মাছ ধরা পড়ে না। এখন বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়ই জেলেরা কীভাবে এল নিনো’র ঘটনা ধরতে পেরেছিল।

এল নিনো এবং লা নিনা উভয়ই বিরূপ আবহাওয়া, দাবানল, বাস্তুতন্ত্র এবং অর্থনীতিতে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারে। এল নিনো এবং লা নিনা’র পর্বগুলো সাধারণত নয় থেকে ১২ মাস স্থায়ী হয় তবে কখনও কখনও কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। এল নিনো এবং লা নিনা ঘটনাগুলো গড়ে প্রতি দুই থেকে সাত বছর পর পর ঘটে, তবে সেগুলো নিয়মিত সময়সূচিতে ঘটে না। সাধারণত, এল নিনো লা নিনা’র চেয়ে বেশি ঘন ঘন ঘটে।

এতোক্ষণ জানলে এল নিনো’র ঘটনা। এবার শোনো লা নিনা’র ঘটনা। লা নিনাএর সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলা বায়ুর চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে। সমুদ্রের উত্তপ্ত পানি প্রবাহিত হতে থাকে পশ্চিম দিকে। আর সমুদ্রের গভীর থেকে শীতল পানি উপরে উঠে আসে। এর ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় কম হয়। লা নিনা’র কারণে বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলে মারাত্মক হারিকেন আঘাত হানতে পারে। তাহলে বুঝতে পেরেছো পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা কতটা জরুরি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরসমালাই ও সন্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধলতিফপুরে চুলার আগুন পুড়ল ৬ বসতঘর