এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নতুন ডিজাইন

বিরোধ মিটল চসিক-সিডিএর

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৮ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:২৪ পূর্বাহ্ণ

টাইগারপাসের পাহাড় রক্ষায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বিরোধ মিটে যাচ্ছে। পাহাড় রক্ষা করে সিডিএ প্রকল্পটির নয়া যে ডিজাইন করেছে তাতে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী সম্মতি জানিয়েছেন বলে দাবি সিডিএর। তবে মেয়র বিষয়টি নিয়ে ভাবছেন বলে উল্লেখ করে বলেন, সবার জন্য ভালো হয় এমন সিদ্ধান্তই আমরা নেব। টাইগারপাসের পাহাড় না কেটে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুফল যাতে পুরোপুরি পাওয়া যায় সেজন্য দেওয়ানহাট থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভারের ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। প্রকল্পটির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিএটিএস-এমআইএসটির বিশেষজ্ঞ টিম পরিচালিত সমীক্ষার পর এক্সপ্রেসওয়েকে আরো গণমুখী করতে নতুন এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন ডিজাইনে জিইসি মোড়, আমবাগান রাস্তার মাথা এবং টাইগারপাস মোড়ে নতুন র‌্যাম্প নির্মাণ করা হবে। এতে ফ্লাইওভারটির ব্যবহার বাড়বে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, নগরীর যান চলাচলে গতি আনতে লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সন্নিকটস্থ টানেল রোড পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সিডিএ। নগরীর যেকোনো অংশ থেকে মানুষ যাতে ২০ থেকে ২৫ মিনিটে বিমানবন্দরে পৌঁছতে পারেন সেজন্যই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বলা হলেও মূলত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুরু হচ্ছে বহদ্দারহাট থেকে। বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার থেকে নেমে মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার ফ্লাইওভার পর্যন্ত আসার পর এখান থেকে বিমানবন্দরে আসা যাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল কাঠগড় থেকে। পরবর্তীতে ধাপে ধাপে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ চলছে। পতেঙ্গা থেকে আসা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটিতে দেওয়ানহাট থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত এসে পাহাড়ের পাদদেশ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে রাস্তাটি নেয়ার সময় পাহাড় কাটা এবং টাইগারপাসের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন ওঠে। অপরদিকে ফৌজদারহাট বায়েজিদ লিংক রোডে পাহাড় কেটে বেকায়দায় থাকা সিডিএ নতুন করে আর কোনো পাহাড় না কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন সংকট দেখা দেয়।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নতুন করে সমীক্ষা পরিচালনা এবং ডিজাইন পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। সিডিএ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিএটিএস-এমআইএসটিকে পুরো বিষয়টি নিয়ে আবারো সমীক্ষা পরিচালনা করে। বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দেওয়ানহাট থেকে ওয়াসা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নতুন ডিজাইন তৈরির প্রস্তাব দেয়। এতে টাইগারপাসের পাহাড়ের কোনো ক্ষতি না করেই নতুন করে ডিজাইন তৈরি করা হয়।
নতুন ডিজাইনে বারিক বিল্ডিং থেকে আসা চার লেনের ফ্লাইওভার দেওয়ানহাটে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোডে নির্মিত ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের পশ্চিম পাশ দিয়ে এসে টাইগারপাস পার হয়ে বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়ের রাস্তার সামনে পৌঁছবে। চার লেনের এই ফ্লাইওভার পাহাড়ের দিকে না গিয়ে রাস্তার মাঝখানে থাকবে। পিলারও রাস্তার মাঝখানে হবে। সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ের রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছার পর চার লেনের ফ্লাইওভারের দুই লেন ম্যাজিস্ট্রেট কলোনির আগে রাস্তায় নেমে যাবে। বাকি দুই লেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে গিয়ে ওয়াসা মোড়ে বিদ্যমান আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সঙ্গে যুক্ত হবে। এতে বিমানবন্দর রোড ধরে আসা গাড়িগুলো সড়ক পথে অল্প পথ গিয়ে প্রয়োজনে আবারো ফ্লাইওভারে উঠবে কিংবা নিচ দিয়ে চলে যাবে। এই পয়েন্টে ফ্লাইওভারে ওঠা গাড়িগুলোর জন্য রাস্তা ডেডিকেটেড করে দেওয়া হবে।
অপরদিকে জিইসি মোড়ে পেনিনসুলা হোটেলের পাশ থেকে একটি র‌্যাম্প বিদ্যমান আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে যুক্ত করে দেওয়া হবে। নগরীর নিউ মার্কেট থেকে আসা রাস্তার সঙ্গে টাইগারপাস মোড়ে একটি র‌্যাম্প ফ্লাইওভারে যুক্ত করা হবে। যাতে মুরাদপুর, ষোলশহর দুই নম্বর গেট, জিইসি মোড় এবং নিউ মার্কেট হয়ে আসা গাড়িগুলো অনায়াসে ফ্লাইওভারে উঠে যেতে পারে। এছাড়া আমবাগান রাস্তার মাথায় একটি র‌্যাম্প নামানো হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নয়া ডিজাইন নিয়ে বিরোধিতা করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনও নয়া ডিজাইনের বিরোধিতা করে। নয়া ডিজাইনে প্রকল্পটি টাইগারপাসের পাহাড়ের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেবে বলেও অভিযোগ করা হয়। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এই ডিজাইনের বিরোধিতা করে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের দুইপাশে দুইটি দুই লেনের ওভারব্রিজ নির্মাণ করে টাইগারপাস মোড়েই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শেষ করার প্রস্তাব করা হয়।
সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে দেয়া প্রস্তাব এবং সিডিএর প্রস্তাব নিয়ে গতকাল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মাহফুজুর রহমান। এই সময় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেনটেশনের মাধ্যমে মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নয়া ডিজাইন তুলে ধরার পাশাপাশি সিটি কর্পোরেশনের প্রস্তাবনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দেওয়ানহাটের সঙ্গে টাইগারপাসের লেভেল কমপক্ষে বিশ ফুট পার্থক্য রয়েছে। টাইগারপাস মোড় দেওয়ানহাট থেকে বিশ ফুট উঁচু। এই অবস্থায় দেওয়ানহাট থেকে দুইটি ওভারব্রিজ দুইপাশে নিয়ে আসার সুযোগ নেই। তাছাড়া বিদ্যমান দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ মাত্র ৬ মিটারের মতো উঁচু। কিন্তু বর্তমানে রেলওয়ে ৮.৫ মিটারের কম উচ্চতার কোনো ব্রিজের অনুমোদন দেবে না। দেওয়ানহাট থেকে শুরু করে টাইগারপাস সাড়ে ৮ মিটার (অচিরেই এটি সাড়ে ৯ মিটারের আইন আসছে) উঁচু ব্রিজ ল্যান্ডিং করা অসম্ভব। আবার সাড়ে ৯ মিটার উঁচু না করলে রেলওয়ে ব্রিজ নির্মাণেরই অনুমোদন দেবে না। এতে পুরো প্রকল্পই ঝুলে পড়বে। সিটি কর্পোরেশন টাইগারপাস এলাকায় দুইপাশে ১০ ফুট করে চার লেন করার প্রস্তাব করা হলেও বর্তমানে পৃথিবীর কোথাও ১০ ফুটের লেন নেই। এখন লেন ১২ ফুট। এতে করে মাঝখানে ডিভাইডার রেখে দুই পাশে ২৪ ফুট করে চার লেনের রাস্তা নির্মাণ করতে হলে টাইগারপাসে অবশ্যই পাহাড়ের পাদদেশ কেটে ফেলতে হবে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। নয়া ডিজাইনে এসব সংকট থাকছে না বলে উল্লেখ করে সিডিএ চিফ ইঞ্জিনিয়ার কাজী হাসান বিন শামস বলেন, মেয়র মহোদয়কে আমরা বিষয়টি বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। তিনি আমাদের প্রস্তাবনা বুঝেছেন এবং সম্মত হয়েছেন। তিনি আমাদেরকে দেওয়ানহাট থেকে বারিক বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার এবং রাস্তার পাশে ড্রেন নির্মাণ করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরা এই প্রকল্পের আওতায় রাস্তার বিভিন্ন অংশে ড্রেন নির্মাণ করে দেব। তিনি রাস্তার বিভিন্ন অংশ সংস্কার করে দেয়া হবে বলেও উল্লেখ করেন।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ব্যাপারে সিডিএর চিফ ইঞ্জিনিয়ার এবং প্রকল্প পরিচালক আমার কাছে এসেছিলেন। আমরা কথা বলেছি। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়েছে। বিষয়টি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিষয়গুলো দেখেছি। আমরা এগুলো নিয়ে আরো একটু চিন্তা-ভাবনা করছি। মেয়র বলেন, সবার জন্য ভালো হয় এমন সিদ্ধান্তই আমরা নেব। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চার লেন আগে উপরে ছিল। নয়া ডিজাইনে দুই লেন উপরে রেখে দুই লেনে নিচে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওই দুই লেইনও রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাবে। যাতে পাহাড়ের কোনো ক্ষতি হবে না। এটি একটি ভালো দিক বলেও তিনি মন্তব্য করেন। সিটি মেয়র বলেন, দেওয়ানহাট থেকে বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তাটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আমি অতি দ্রুত এটি কার্পেটিং করে দিতে বলেছি। সিডিএ আগামী দেড় মাসের মধ্যে রাস্তাটি কার্পেটিং করে দেবে বলে সম্মত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৬.৪ শতাংশ : বিশ্ব ব্যাংক
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬