এলপি গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেট

পুরনো সিলিন্ডারে ডিলারদের 'হাত বাঁধা' ।। আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দাম বাড়াচ্ছে বড় কোম্পানীগুলো

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২১ at ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ

এলপি গ্যাস মূলত হাইপ্রোকার্বন গ্যাসের মিশ্রণ। মূলত প্রোপেন ও বিউটেনের সংমিশ্রণে এলপি গ্যাস তৈরি করা হয়। বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম না থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৩০:৭০ অনুপাতে প্রোপেন ও বিউটেনের মিশ্রণ করা হয়। আর বিশ্ববাজারে সৌদি আরামকোর প্রকাশিত দরকে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়। আরামকোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাজারদর প্রতি টন প্রোপেন ৫৬৫ ডলার ও বিউটেন ছিল ৫৯০ ডলার। কোডিভ প্রাদুর্ভাবের কারণে ব্যবহার ও বিপণন কমে যাওয়াতে বিগত বছরের এপ্রিল মাসে অস্বাভাবিকভাবে এলপি গ্যাসের দামের পতন হয়। এপ্রিল মাসে প্রোপেন ২৩০ ডলার ও বিউটেন ২৪০ ডলারে নেমে আসে। পরবর্তীতে বাড়তে থাকে দাম। চলতি জানুয়ারি মাসের বাজারদর প্রতি টন প্রোপেন ৫৫০ ডলার ও বিউটেন ৫৩০ ডলার নির্ধারিত রয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বর্তমানে প্রতিটন প্রোপেনে ১৫ ডলার ও বিউটেনে ৬০ ডলার করে কম। অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে গড় দাম ছিল ৫৮২.৫০ ডলার। যা চলতি জানুয়ারি মাসে দাম হচ্ছে ৫৩৬ ডলার। হিসেব অনুযায়ী বছরের ব্যবধানে প্রতি টনে দাম কমেছে ৪৬ ডলার। তবে গত ডিসেম্বরে গড় দাম ছিল ৪৫৭ ডলার এবং নভেম্বরে ছিল ৪৩৭ ডলার।
এদিকে চট্টগ্রামে এলপি গ্যাসের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে কম থাকলেও বছরের ব্যবধানে প্রতি ১২ কেজির বোতলে দাম বেড়েছে ৫০ টাকার মতো। হালিশহর এলাকার সুপার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির স্বত্বাধিকারী জহুরুল হক জম্মু দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘দেশে বর্তমানে প্রায় সব বড় কোম্পানির গ্যাস প্রতি বোতল ৯৩০-৯৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিস্ট্রিবিউটররা কমিশন ছাড় দিয়ে ভোক্তাদের কাছে কিছু কমে বিক্রি করছেন। একবছর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে দাম আরো কম ছিল। গত নভেম্বর মাসেও দাম ছিল ৮৪০ টাকার মতো।’ তিনি বলেন, ‘বাজারে পুরনো বড় কোম্পানির বোতল (সিলিন্ডার) বেশি। তাই বাজারে তাদের নিয়ন্ত্রণও বেশি।’
চকবাজার ও বাকলিয়া এলাকার রংধনু এন্টারপ্রাইজের স্বত্তাধিকারী মো. করিম বলেন, ‘কয়েক মাস আগেও এলপি গ্যাস বিক্রিতে প্রতিমাসে টার্গেট নির্ধারণ করে দেওয়া হতো। দৈনিক আজাদীতে এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন আসার পর থেকে কোম্পানিগুলো এখন টার্গেট দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাকলিয়া এলাকার আরেক এলপিজি ডিলার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘বড় কোম্পানিগুলোর কাছে আমাদের হাত বাঁধা। কারণ ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে অনেক সিলিন্ডার। বড় কোম্পানিগুলোর সিলিন্ডারই বেশি। যে কোম্পানির সিলিন্ডার সেই কোম্পানি থেকেই রিফিল করতে হয়। এতে তারা দাম বাড়ালেও আমাদের কিছু করার থাকে না।’
এলপিজি বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ আজাদীকে বলেন, এলপিজি দেশের সম্ভাবনাময় একটি খাত। এটির দিন দিন ব্যবহার বাড়ছে। বর্তমানে যে নীতিমালার মাধ্যমে এলজিপি ব্যবসা পরিচালিত হচ্ছে, সেটি হচ্ছে বৈষম্যমূলক। এই নীতিমালা প্রণয়নে বড় অপারেটরদের হাত ছিল। নীতিমালায় তাদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার বৈষম্যের কারণে ছোট অপারেটর (বোটলার ও স্যাটেলাইট অপারেটর) ও ডিস্ট্রিবিউটররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। সুস্থ ও সুন্দর নীতিমালার অভাবে ছোট অপারেটরদের ব্যাংক লোনসহ বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ৫৫টির মতো অপারেটর অনুমোদন পেলেও ২৭টি অপারেটর এলপিজি বিপণন করছে। সারাদেশে বাজারে বর্তমানে ১২ কেজির সিলিন্ডার রয়েছে প্রায় দুই কোটির মতো। তন্মধ্যে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ সিলিন্ডার হচ্ছে বড় ৬ অপারেটরের। বাজারে বেশি সিলিন্ডার থাকার কারণে পুরনো এবং বড় অপারেটররাই আধিপত্য করছে। সুষ্ঠু নীতিমালা নেই বলে যে যার মতো দর নির্ধারণ করছে। এখন নতুন বিনিয়োগকারীরা বাজারে এসে বিপাকে পড়ছেন। তারা বাজারে ঢুকতে পারছেন না। কারণ অপারেটরদের কাছ থেকে ডিস্ট্রিবিউটরা সিলিন্ডার কিনে নেন। ডিস্ট্রিবিউটরা সিলিন্ডার কেনার জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করতে চাইছেন না। ফলে মার্কেটে যাদের সিলিন্ডার বেশি তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন। তবে নতুন উদ্যোক্তারা বাজারে প্রবেশ করতে পারলে বাজার আরো প্রতিযোগিতামূলক হতো। এতে ভোক্তারাই বেশি সুবিধা পেত। এজন্য ছোট-বড় সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালার বিকল্প নেই।’
এলপিজি বোটলার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লাবাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পদ্মা এলপিজি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামীম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘১২ কেজির একটি একটি খালি সিলিন্ডার তৈরিতে ১৮শ থেকে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু অপারেটররা ৭০০-৭৫০ টাকায় ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে বিক্রি করছে। এতে শুরুতেই প্রতি সিলিন্ডারে ১১শ থেকে ১২শ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এটি বড় বিনিয়োগ। অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই দীর্ঘ দুই বছর ধরে বাজারের চেয়ে কমমূল্যে এলপিজি বিক্রি হচ্ছে। এতে ছোট বড় সব বিনিয়োগকারীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সবাই পুঁজি হারাচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘বিগত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের দাম বাড়ছে। যে কারণে দেশের বাজারেও তার প্রভাব পড়ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্যাটেলাইট অপারেটরের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী বলেন, ‘বড় কোম্পানিগুলোর সিলিন্ডার বাজারে বেশি। সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে তারাই বেশি লাভবান হচ্ছে। ডিস্ট্রিবিউটরদের হাতে যে পরিমাণ সিলিন্ডার আছে সেগুলো রিফিল করে ব্যবসা চালাচ্ছে। শুধুমাত্র সিলিন্ডারের কারণে চাইলেই নতুন অপারেটররা বাজারে ঢুকতে পারছে না। কারণ ডিস্ট্রিবিউটররা নতুন করে সিলিন্ডার কিনতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে এলপিজি ব্যবসায়ের নিয়ন্ত্রণ বড়দের হাতেই রয়ে যাচ্ছে।’
দেশে এলপি গ্যাসের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও দাম একটি স্তরে নিয়ে আসার জন্য গত ১৪, ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি গণশুনানি করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। সরকারি প্রতিষ্ঠান এলপিজিএলের গ্যাসের দাম বর্তমানে ১২ কেজির প্রতি সিলিন্ডার ৬০০ টাকা। এলপিজিএল এটির দাম ৭শ টাকা করার প্রস্তাব দিলেও বিইআরসি চাইছে ৯শ টাকা নির্ধারণ করতে। এটিও সাম্প্রতিক দেশের বাজারে এলপি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।
এ ব্যাপারে বিপিসির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান এলপি গ্যাস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুর রহমান খান অভিযোগ করে দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা চাইছি ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি সিলিন্ডার ৭০০ টাকা করতে। ৭০০ টাকা বিক্রি করলে আমাদের লোকসান হবে না। কিন্তু বিইআরসি চাইছে আমাদের সিলিন্ডার ৯০০ টাকা নির্ধারণ করতে। এতে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো লাভবান হবে। দাম বাড়ানো হলেও প্রতিযোগিতামূলক বাজারে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। বিইআরসি কাদের স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে আমাদের বোধগম্য নয়। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা লিখিতভাবে জানিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে লোয়াব। তারা আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিয়ে দাম বাড়াচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে দাম বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ানো হচ্ছে আমাদের বাজারে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৪১ সালের আগেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে : তথ্যমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ ঘিরে নিরাপত্তা মহড়া