সীতাকুণ্ডের তুলাতলীতে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র স্ক্র্যাপ লোহার মূল্যবৃদ্ধির পর এলপিজি সিলিন্ডার কেটে স্ক্র্যাপ করা শুরু করে। দেশের নানা স্থান থেকে সিলিন্ডার সংগ্রহ করে প্রতি রাতে সেগুলো কেটে স্ক্র্যাপ বানিয়ে বিভিন্ন রি-রোলিং মিলে সরবরাহ দিচ্ছিল। এক একটি সিলিন্ডার গড়ে তিন চারশ’ টাকা ব্যবসা করে চক্রটি রি-রোলিং মিলে সরবরাহ দেয়। বিভিন্ন সংস্থাকে ম্যানেজ করে সীতাকুণ্ডের তুলাতলির চক্রটি প্রতিদিন গড়ে দশ হাজারের মতো সিলিন্ডার কেটে স্ক্র্যাপ বানাতো বলেও অভিযোগ রয়েছে। রাতে তাদের সিলিন্ডার কাটার তীব্র শব্দে এলাকাবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের পক্ষ থেকে নানাভাবে অভিযোগ করা হলেও সিলিন্ডার কাটার মহোৎসব থামানো যায়নি। অবশেষে র্যাবের একটি দল টানা দুদিন অভিযান চালিয়ে এই চক্রের মুল হোতা স্থানীয় জনৈক শফিউর রহমানের ছেলে ইসমাইল হোসেন কুসুম প্রকাশ এলপি কুসুমসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের মধ্যে ফয়েজ আহাম্মদের ছেলে মহসীন, সিদ্দিকের ছেলে নুরুন নবী কুসুমের ডান এবং বাম হাত হিসেবে পুরো সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করতো বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে।
ইসমালই হোসেন কুসুম গত জুলাই মাসে সিলিন্ডার কাটার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিল। পরবতীতে জামিনে এসে সে দ্বিগুন উৎসাহে সিলিন্ডার কাটার কার্যক্রম পরিচালনা করে। র্যাব সদস্যরা অভিযানের সময় এলপি কুসুমসহ সংশ্লিষ্টদের চারটি আস্তানা থেকে কাটার জন্য জড়ো করা ১০ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার জব্দ করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, দেশের ২৭টি এলপিজি অপারেটর নিজেদের ব্যবসা পরিচালনার বিনিয়োগ হিসেবে লাখ লাখ এলপিজি সিলিন্ডার বাজারে ছেড়েছে। নিজেদের পরিবেশক এবং রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোর মাধ্যমে এসব সিলিন্ডার গ্রাহকদের কাছে দেয়া হয়। গ্রাহকেরা আটশ’ থেকে এক হাজার টাকায় সিলিন্ডার কিনে গ্যাস রিফিল করেন। একজন গ্রাহক যে কোম্পানির সিলিন্ডার কিনেন পরবর্তীতে ওই কোম্পানির কাছ থেকেই গ্যাস রিফিল করতে বাধ্য হন। যমুনা এলপিজির সিলিন্ডারে বসুন্ধরা এলপিজি রিফিল করার সুযোগ নেই। অতি উন্নতমানের এবং দামি লোহা দিয়ে তৈরি একটি সিলিন্ডার কমপক্ষে ২০ বছর ব্যবহার করা হয়। এতে করে শুরুতে দেড় দুই হাজার টাকা ভুর্তুকি দেয়া হলেও পরবর্তীতে প্রতি রিফিলে মুনাফার কারণে অপারেটরেরা ভুর্তুকি পুষিয়ে নেন।
কিন্তু সীতাকুণ্ডের তুলাতলীতে গড়ে উঠা সংঘবদ্ধ একটি চক্র সারা দেশ থেকে নানা কৌশলে সিলিন্ডারগুলো সংগ্রহ করে কেটে স্ক্র্যাপ হিসেবে বিভিন্ন রি-রোলিং মিলে বিক্রি করে দিচ্ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের উদ্বৃতি দিয়ে র্যাব জানায়, রাতের বেলা যখন সিলিন্ডার কাটা শুরু হয় তখন সিলিন্ডারের ভেতরে জমে থাকা গ্যাস বের হয়ে পুরো এলাকায় গ্যাসের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া সিলিন্ডার কাটার সময় বিকট টানা শব্দ হয়, যাতে এলাকাবাসী রাতে ঘুমাতে পারতেন না। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা আপত্তি করলেও বিভিন্ন সংস্থাকে ম্যানেজ করার কসুম সিন্ডিকেটের অপতৎপরতা থামানো যায়নি।
সূত্র বলেছে, সিলিন্ডার অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। একটি সিলিন্ডার কীভাবে তৈরি হবে তা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার অনুমোদন লাগে। বিস্ফোরক আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট অপারেটর অনুমোদন ছাড়া নিজেদের সিলিন্ডারের আকারও পরিবর্তন করতে পারে না। পারে না কোনো বিকল্প ব্যবহার করতে। সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১ অনুযায়ী ‘কোনো অবস্থায়ই সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ, কাটা কিংবা আঘাত করা যাবে না। সিলিন্ডার নষ্ট হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই সেটি নষ্ট করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার সিলিন্ডার সংগ্রহ করে সীতাকুণ্ডে এনে কেটে স্ক্র্যাপ করার ঘটনায় এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সংস্থার কাছে পত্র দিয়ে দেশের এই ক্ষতি ঠেকানোর আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু সংঘবদ্ধ চক্রটির অপতৎপরতা ঠেকানো কঠিন হয়ে উঠেছিল। অবশেষে র্যাব সদস্যরা টানা দুদিন অভিযান চালিয়ে কুসুম সিন্ডিকেটের মুল হোতাসহ ৯জনকে গ্রেপ্তার এবং দশ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার জব্দ করে।
র্যাব জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্রাপ লোহার দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় কুসুমের নেতৃত্বে তুলাতলী এলাকার বাসিন্দা মহসিন, নবী, মঈনুদ্দিন মেম্বার, তার ভাই সাইফুদ্দিন, টিটু শাহীন, রফিকসহ কয়েকজন একটি সিন্ডিকেট গঠন করে।
গতকাল সকালে ১০টা নাগাদ তুলাতলী বেড়িবাঁধের ধারে অবৈধ গ্যাস সিলিন্ডার কাটার কারখানায় সংবাদ সম্মেলন করেন র্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ। তিনি বলেন, প্রতিটি কোম্পানি ২ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে ক্রয় করে ভর্তুকি মূল্যে গ্রাহকের কাছে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করে। কিন্তু দেশে স্ক্যাপ লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় একটি চক্র গ্যাস সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই নানা কৌশলে সিলিন্ডার সংগ্রহ করে তা কেটে স্ক্র্যাপ লোহা হিসেবে বিক্রি করে আসছিল। এতে বাজার থেকে সিলিন্ডার দিন দিন কমে যাচ্ছে। এতে বিদেশ থেকে চড়া দামে লোহা আমদানি করে নতুন সিলিন্ডার তৈরি করে বাজারে ছাড়তে হচ্ছিল। সংশ্লিষ্ট অপারেটগুলোও বাড়তি খরচের কবলে পড়ছিল।
র্যাব জানায়, সিলিন্ডারগুলোর ভেতরে কিছু গ্যাস অবশিষ্ঠ থাকে। সিলিন্ডার কাটার সময় যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে। বিএম কন্টেনার ডিপোতে সংঘটিত বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যুর পর গোয়েন্দা সূত্রে সিলিন্ডার কাটার বিষয়টি জানতে পেরে র্যাব অভিযান পরিচালনা করে বলেও লেঃ কর্ণেল মোহাম্মদ ইউসুফ জানান। তিনি গত মঙ্গলবার থেকে অভিযান চালিয়ে দুদিন চারটি পৃথক স্থানে রাখা ১০ হাজার সিলিন্ডার র্যাব সদস্যরা জব্দ করেন বলেও জানান। এ ঘটনায় মামলা রুজু করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, এলপিজি সিলিন্ডার তৈরি হয় শতভাগ আমদানিকৃত স্টিল দিয়ে। জাপান, চীন, কোরিয়া, তুরস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে উন্নতমানের স্টিল আমদানি করে তৈরি করা হয় এসব সিলিন্ডার। দেশের ১৭/১৮টি সিলিন্ডার প্ল্যান্ট বর্তমানে সিলিন্ডার উৎপাদন করে। দেশের সাধারণ গ্যাস ব্যবহারকারীদের কথা বিবেচনা করে সরকার এই স্টিল আমদানিতে কোনোরূপ শুল্ক আরোপ করেনি। শুধুমাত্র ভ্যাট এবং সামান্য আয়কর প্রদানের মাধ্যমে এলপিজি সিলিন্ডারের লোহা আমদানি করা হয়। প্রতিটি সিলিন্ডারে ১৮ কেজি লোহা ব্যবহৃত হয়। একটি সিলিন্ডার বানাতে খরচ হয় আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা। এসব সিলিন্ডার ভুর্তুকি দিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো বাজারে ছাড়ে। আড়াই থেকে তিন হাজার টাকার সিলিন্ডারটি সংশ্লিষ্ট এলপিজি কোম্পানিগুলো আটশ’ থেকে এক হাজার টাকায় গ্রাহককে প্রদান করে। পরবর্তীতে গ্যাস রিফুয়েলিং থেকে কোম্পানিগুলো ব্যবসা করার আশায় প্রতিটি সিলিন্ডারে গড়ে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ভুর্তুকি দেয়া হয়। দেশে বর্তমানে ২৭টি এলপিজি কোম্পানি রয়েছে। এসব কোম্পানির তিন কোটিরও বেশি গ্যাস সিলিন্ডার বাজারে রয়েছে।