বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রতি হাজার ঘনফুট তিন ডলার থেকে ৭ ডলারের উপরে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির কারণে এলএনজি আমদানি নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে পেট্রোবাংলা। যে কারণে স্পটমার্কেট থেকে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে পরিকল্পনামাফিক ৪ লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার এলএনজি আমদানি করা থেকে পিছিয়ে এসেছে রাষ্ট্রীয় গ্যাস জ্বালানি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানটি। এতে সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহেও প্রভাব পড়েছে। প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিলেও সামনের দিনগুলোতে আবাসিক গ্রাহকদের মাঝে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি. (কেজিডিসিএল)।
কেজিডিসিএল সূত্রে জানা যায়, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্পখাত মিলিয়ে চট্টগ্রাম গ্যাসের গ্রাহক রয়েছে ৬ লাখের বেশি। তন্মধ্যে আবাসিক গ্রাহক ৫ লাখ ৯৮ হাজারের কাছাকাছি। তাছাড়া শিল্প গ্রাহক রয়েছে ১১২৭, বাণিজ্যিক গ্রাহক ২৮৬২, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১৯০, সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন ৭০টি, বিদ্যুৎকেন্দ্র ৫টি ও সার কারখানা রয়েছে ৪টি। সবমিলিয়ে চট্টগ্রামে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা থাকে ৪৮০-৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এলএনজি আমদানির আগে চাহিদার বিপরীতে চট্টগ্রামে মাত্র ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম গ্যাস পেত চট্টগ্রামের গ্রাহকরা।
দেশে গ্যাসের সংকট কাটাতে এলএনজি আমদানি ও সারাদেশে সরবরাহের জন্য ৫ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের মাধ্যমে (জিটিসিএল) চারটি মেগা পাইপলাইন নির্মাণ করে পেট্রোবাংলা। এরমধ্যে ১ হাজার ৩৯ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে মহেশখালী-আনোয়ারা গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন, ৭৭৬ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে আনোয়ারা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত পাইপলাইন, ১ হাজার ৩১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকায় মহেশখালী-আনোয়ারা প্যারালাল (সমান্তরাল) গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন এবং ২ হাজার ৪৭৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ পাইপলাইন নির্মাণ করে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লি. (জিটিসিএল)।
এছাড়া আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহের জন্য সরকারি চুক্তির মাধ্যমে মহেশখালীতে দুটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ এন্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট অর্থাৎ এলএনজি মজুত ও পুনরায় গ্যাসে রূপান্তর করার ভাসমান টার্মিনাল) নির্মাণ করে এঙিলারেট এনার্জি ও সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড। টার্মিনাল দুটি হতে দৈনিক এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নির্মিত সঞ্চালন পাইপলাইনের মাধ্যমে সারাদেশে সরবরাহের কথা রয়েছে। ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট জাহাজ থেকে এফএসআরইউর মাধ্যমে ট্রান্সমিশন লাইনে গ্যাস সরবরাহ দিতে সক্ষম হয় পেট্রোবাংলা। এ পর্যন্ত আমদানিকৃত এলএনজি হতে এপর্যন্ত দৈনিক সর্বোচ্চ ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দিতে সক্ষম হচ্ছে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এর আগে দীর্ঘমেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার ও ওমান থেকে জিটুজি পর্যায়ে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ১৫ বছরের জন্য কাতারের সাথে চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। একইভাবে ওমানের সাথে ২০১৮ সালের ৬ মে ১০ বছরের জন্য চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৮ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে ৪২টি এবং চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৭টি কার্গো সরবরাহ করে কাতার। অন্যদিকে ২০১৯ সালের ২২টি, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২১টি কার্গো সরবরাহ করে ওমান। তাছাড়া গত মার্চ থেকে কোভিড সংক্রমণের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির চাহিদা কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে যায় এলএনজির। এতে মূল্য সাশ্রয়ের জন্য স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করে পেট্রোবাংলা। সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্পট মার্কেট থেকে প্রথম এলএনজি কার্গো আমদানি করা হয়। গড়ে প্রত্যেকটি কার্গোর ধারণ ক্ষমতা এক লক্ষ ৪০ হাজার ঘনমিটার।
বর্তমানে বিশ্ববাজারে হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে এলএনজির দাম। এতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় পেট্রোবাংলা। এতে গ্যাস সরবরাহে সংকট তৈরি হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহে রেশনিং শুরু করা হয়। চট্টগ্রামে গত ১ নভেম্বর ৩৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পায় কেজিডিসিএল। পরে ধীরে ধীরে সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে রেশনিং পদ্ধতি চালু করে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি। ধারাবাহিকভাবে ৪ নভেম্বর ৩৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, ৬ নভেম্বর ২৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট, ৭ নভেম্বর ৩১১ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ১০ নভেম্বর ৩১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয় কর্ণফুলী গ্যাস।
জানতে চাইলে আরপিজিসিএলর মহাব্যবস্থাপক (এলএনজি) মো. রফিকুল ইসলাম দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় বিশ্বে সব ধরণের জ্বালানির দাম কমে যায়। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে এক এমএমডিকিউ (প্রতি হাজার ঘনফুট) এলএনজি দাম তিন ডলারের নীচে নেমে গিয়েছিল। এখন আবার হু হু করে বাড়ছে। বর্তমান বাজারে দাম ৭ ডলারের উপরে উঠে গেছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কম থাকায় স্পট মার্কেট থেকে আমরা এলএনজি আমদানি শুরু করেছিলাম। পরিকল্পনামাফিক নভেম্বর মাসে একটি এবং ডিসেম্বর মাসে দুটি এলএনজিবাহী কার্গো আমদানির কথা ছিলো। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এই তিনটি কার্গো আমদানি স্থগিত করে দেওয়া হয়। গড়ে প্রত্যেকটি কার্গোর ধারণ ক্ষমতা প্রায় এক লক্ষ ৪০ হাজার ঘনমিটার।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের জিটুজি সাপ্লাইয়ার থেকে স্পট মার্কেটে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটি স্পটমার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির বিষয়ে অনুমোদন নাও দিতে পারেন। সে কারণে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে স্পট মার্কেট হতে এলএনজি আমদানির বিষয়ে সুপারিশ করা হয়নি। এতে দেমে গ্যাস সরবরাহে সামান্য প্রভাব পড়তে পারে।’
গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলছে না কেজিডিসিএলের কেউ। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেজিডিসিলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চট্টগ্রামে গ্যাসের রেশনিং করার বিষয়টি স্বীকারে করে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে বর্তমানে হঠাৎ করে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। এমনিতে এলএনজি আমদানি করে গ্রাহকদের গ্যাস সরবরাহ দিতে মোটা অংকের ভর্তুকি গুণছে সরকার। বর্তমানে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ভর্তুকির পরিমাণও বেড়ে গেছে। যে কারণে পেট্রোবাংলায় বৈঠক করে এলএনজি আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘এলএনজি আসার পর থেকে চট্টগ্রামে আমরা দৈনিক ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস পাচ্ছিলাম। এখন সেটা ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কাছাকাছি গ্যাস পাওয়া যাবে। আপাতত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ আগামীতে আবাসিক এবং শিল্প গ্রাহকেও প্রভাব পড়তে পারে বলে মত প্রকাশ করেন এ কর্মকর্তা।