এম এ মালেকের একুশে পদক প্রাপ্তি ও চট্টগ্রামের গণমাধ্যম শিল্প

আবদুল মান্নান | বুধবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ১১:১৫ পূর্বাহ্ণ

পারিবারিক নাম মোহাম্মদ আবদুল মালেক, সকলে তাঁকে চেনেন মালেক ভাই হিসেবে। চট্টগ্রামের অন্যতম প্রাচীনতম দৈনিক বাংলা পত্রিকা আজাদীর সম্পাদক। এই বছর তিনি সাংবাদিকতায় তাঁর অবদানের জন্য আরো মোট ২৪ জনের মধ্যে তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। মালেক ভাইকে এই পদক প্রাপ্তিতে অভিনন্দন। বেশ কয়েকবছর ধরে একটি রেওয়াজ হয়ে গেছে যারা এই পদকে পান তাঁদের অনেকেই মরণোত্তর পদকে ভূষিত হন। এই বছর চব্বিশ জনের মধ্যে তেমন পদক প্রাপ্ত রয়েছেন পাঁচজন। মালেক ভাই ভাগ্যবান যে এই পদকটি তিনি জীবিত থাকতে পেয়েছেন। তিনি যে পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন সেই দৈনিক আজাদীর বয়স বর্তমানে বাষট্টি আর মালেক ভাইয়ের বয়স আশি পার হলো। পরিণত বয়সেই তিনি একুশে পদক পেয়ে সম্মানিত হলেন। প্রতি বছর যখন এই পদক প্রাপ্তদেও নাম ঘোষণা করা হয় তখন কয়েকজন কোন যুক্তিতে এই পদক পেলেন তা নিয়ে রীতিমত গবেষণা করতে হয়। এবার তেমন একটা করতে হয়নি।
মালেক ভাইকে দেখলে বিশ্বাস হয় না তিনি আশি বছর পার করে এসেছেন। মনে হবে ত্রিশ পঁত্রিশ বছরের তরুণ। একবার ঢাকা হতে বিমানে আসার সময় পাশের সীটে বসা মালেক ভাইয়ের কাছে বিনয়ের সাথে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর বয়স সম্পর্কে। অকপটে বললেন আশি। তাঁর মুখের দিখে চেয়ে থাকি কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে। তিনি আবার বললেন আশি। ঠাট্টা করে বলি ‘আপনি কি চড়ুই পাখির স্যুপ খান’ ? আমার এক বন্ধু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন একবার বলেছিলেন প্রাচীনকালে মানুষ দীর্ঘদিন যৌবন ধরে রাখার জন্য নাকি চড়ুই পাখির স্যুপ খেতো। এটা বলাতে মালেক ভাইয়ের সেকি হাসি। সে মালেক ভাইয়ের আশি বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে কিছু দিন আগে। কথা দিয়েও সময়োভাবে সেবার লেখা দিতে পারিনি। সেই উদ্যোক্তাদের অভিনন্দন। একই সাথে মালেক ভাইকে আবারো অভিনন্দন, তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
মালেক ভাই সম্পর্কে কিছু লিখতে বা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হবে দৈনিক আজাদী পত্রিকা সম্পর্কে এক সময় যার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন মালেক ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। খালেদ সাহেবের মৃত্যুতে সম্পাদকের দায়িত্বে আসেন। বর্তমানে আছেন এম এ মালেক। ছয় দশকের বেশী সময় (প্রথম প্রকাশ ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬০) নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিছুদিন বন্ধ ছিল) বর্তমানে চট্টগ্রামে শুধু একটি পত্রিকা নয় একটি প্রতিষ্ঠান হিসেব পরিচিত । ঢাকা হতে প্রকাশিত না হওয়ার কারণে হয়তো তাকে জাতীয় দৈনিক বলা হয় না । তবে দৈনিক আজাদী সেই সাথে চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত আরো দু’একটি দৈনিক পত্রিকার প্রচার বা সার্কুলেশন ঢাকার যে কোন পত্রিকার চেয়ে কয়েকগুণ বেশী । দৈনিক আজাদী শত্রুমুক্ত বাংলাদেশ হতে প্রকাশিত প্রথম পত্রিকা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর যে দিন অপরাহ্নে ঢাকার রমনা রেস কোর্স মাঠে যৌথ বাহিনীর কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী আত্মসমর্পণ করে সে দিন সন্ধ্যায় দৈনিক আজাদী পুরো লাল হরফে একটি এক পৃষ্ঠার টেলিগ্রাম বের করে। এই কৃতিত্ব আজাদীর বর্তমান সম্পাদক মালেক ভাইয়ের। কারণ, মূল সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মাদ খালেদ, যিনি সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পরাক্রমশালী ফজলুল কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তখনো তিনি মুক্তিযুদ্ধ হতে ফিরে দৈনিক আজাদীর দায়িত্ব বুঝে নেন নি। সেই সময়ে বয়সে যুবক আজ আশি বছর পার করা তরুণ এম এ মালেকের সৃজনশীলতার সাক্ষ্য বহন করে।
পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা মালেক ভাইয়ের পিতা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ার দু‘বছরের মাথায় ১৯৬২ সালে মৃত্যু বরণ করলে তাঁর জামাতা পত্রিকাটির হাল ধরেন যেহেতু পরিবারে এই দয়িত্ব নেয়ার মতো তখন তেমন কেউ ছিলেন না। মালেক ভাই সম্ভবত স্কুলের গন্ডি পার হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছেন বা কলেজ শেষ করেছেন। এই সময় এগিয়ে আসেন অধ্যাপক মোহাম্মাদ খালেদ। তাঁর হাত ধরেই দৈনিক আজাদী হয়ে উঠে চট্টগ্রামের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক। তখন ঢাকা হতে চট্টগ্রামে পত্রিকা পৌঁছাতো পর দিন কারণ ঢাকার বাইরে অন্যান্য জেলাগুলো ছিল মফস্বল। ঢাকার পত্রিকায় দু’টি ডেট লাইন থাকতো। ঢাকা আর মফস্বল। দু’আনা দামের দৈনিক আজাদী ভোরেই পাঠকের হাতে পৌঁছে যেত।
এক সময় প্রকাশনা শিল্পে চট্টগ্রাম ঢাকা হতেও অগ্রগামী ছিল। চার লক্ষ জনসংখ্যার শহর হতে চারটি ইংরেজি দৈনিক, নয়টি বাংলা ও একটি উর্দু দৈনিক প্রকাশিত হতো এবং তার পাঠকও ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরপরই কবি আবদুস সালাম প্রকাশ করলেন দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান। দৈনিক আজাদী পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তিনি ভারতের শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হতে পাশ করে বেছে নিয়েছিলেন পত্রিকা প্রকাশের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব। আন্দরকিল্লায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বইয়ের দোকান কোহিনুর লাইব্রেরি । অদূরে কাটাপাহাড়ে বসিয়েছিলেন কোহিনুর ইল্কেট্রিক প্রেস যেখান হতে ছাপা হতো দৈনিক আজাদী। পত্রিকাটি প্রকাশের বছর দুই পরে খালেক সাহেবের মৃত্যু হলে পত্রিকার হাল ধরেন তাঁর জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। মালেক ভাইয়ের সুযোগ হয়েছিল খালেদ সাহেবের সাথে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে থেকে কাজ শেখার।
টক টকে ফর্সা মালেক ভাইয়ের ভদ্রজনিত ব্যবহার যে কাউকে সম্মোহিত করে। বেশ আমুদে মানুষ হিসেবে পরিচিত সদা হাস্য মালেক ভাই । সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সমমনা মানুষদের নিয়ে তিনি আড্ডা দিতে বেশ পছন্দ করেন। অধ্যাপক খালেদ আওয়ামী লীগের মতাদর্শে দিক্ষীত থাকলেও মালেক ভাই রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চিন্তা চেতনার প্রতি আজীবন আনুগত্য থেকেছেন। তাঁর পত্রিকায় যারা কাজ করেন তারাও একই চিন্তাধারার মানুষ। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে দৈনিক আজাদী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যার কৃতিত্ব এই পত্রিকার সংবাদ কর্মী আর মালেক ভাইয়ের। এই বিষয়ে সব সময় সমর্থন যুগিয়েছেন পত্রিকাটির সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। মালেক ভাইয়ের স্মরণযোগ্য কীর্তি হচ্ছে দৈনিক আজাদী হতে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ শিরোনামে একটি তথ্যবহুল ও সমৃদ্ধ সংকলন প্রকাশ করা। এই কাজটি করার কথা কোন একটি গবেষণা সংস্থার। কিন্তু তা প্রকাশিত হলো মালেক ভাইয়ের উদ্যোগে দৈনিক আজাদী হতে। এমন একটি প্রকাশনার জন্য এই দেশের মানুষকে দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এই একটি প্রকাশনা তাঁকে চট্টগ্রামের মানুষের কাছে অমর করে রাখবে। মালেক ভাইয়ের আর একটি বড় গুণ হচ্ছে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক জগতের সাথে সম্পর্ক। এক সময় চট্টগ্রামের ক্রীড়া আর সাংস্কৃতিক জগতের প্রাণপুরুষ ছিলেন ডাঃ কামাল এ খান যিনি সর্বাধিক কামাল ভাই হিসেবে পরিচিত। চাকুরি সূত্রে ছিলেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের হাসপাতালের প্রধান কর্মকর্তা। দৈনিক আজাদী অফিসের কাছেই মোমিন রোডে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত চেম্বার। তিনি চেম্বারে রোগী দেখার চেয়ে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সাথে বিকেলে আড্ডা মারতে বেশী পছন্দ করতেন। সেখানেও মাঝে মাঝে আসতেন মালেক ভাই আড্ডায় সামিল হতে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে চট্টগ্রামের শিক্ষক, সংষ্কৃতি কর্মী, লেখক, সাংবাদিক, পেশাজীবীসহ অনেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সর্বাত্মক সহায়তা করেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। নিউ মার্কেট চত্তরে স্থাপিত হয় স্থায়ী মঞ্চ। সেই মঞ্চ হতে প্রায় প্রতিদিনই এরশাদ বিরোধী সভা হতো। দৈনিক আজাদী সব সময় এই সভার কার্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করতো। তাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতেন অধ্যাপক খালেদ আর মালেক ভাই।
মালেক ভাইয়ের সব চাইতে বড় গুণ সম্ভবত তিনি সকলকে খুব স্বল্প সময়ে আপন করে নিতে পারেন। তাঁর পত্রিকায় কাজ করতে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন কীর্তিমান লেখক ও সাংবাদিক সাধন বাবু, দাদামনি নামে সকলের কাছে পরিচিত অরুন দাসগুপ্ত, ওবায়দুল হক, মোহাম্মদ ইউসুফের মতো মানুষদের। দৈনিক আজাদীতে কাজ করতে এসেছিলেন এক ঝাঁক তরুণ। দেশেতো বর্তমানে পত্রিকার অভাব নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের মানুষের এখনো সকালে এই শহর হতে প্রকাশিত কোন একটি পত্রিকা না পেলে যেন দিনই শুরু হয় না কারণ এই পত্রিকাগুলোতে থাকে স্থানীয় সব খবর । বিয়ে শাদী হতে শুরু করে মৃত্যু সংবাদ কোন কিছুই বাদ যায় না। কিছুটা যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটি পত্রিকার মতো তবে চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোতে দেশের এবং আন্তর্জাতিক সংবাদও কম গুরুত্ব পায় না ।
এই শহর হতে অতীতে যে সকল পত্রিকা প্রকাশিত হতো তার অনেকগুলোই আজ আর প্রকাশিত হয় না । তবে নূতন কিছু পত্রিকা এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে । এর অর্থ হচ্ছে এই শহরে সৃজনশীল মানুষের অভাব এখন পর্যন্ত হয় নি । কেবল শহরটা অবহেলিত। এরা সকলে অনুপ্রাণিত হয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক, মাহবুবুল আলম, ইউসুফ চৌধুরী (দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা), এম এ মালেকের মতো বিদ্যুষি ব্যক্তিদের মতো মানুষের দ্বারা । এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে মালেক ভাইদের পরবর্তি প্রজন্ম কি তেমন ভাবে প্রস্তুত তাঁদের মতো দায়িত্ব পালন করতে । একুশে পদক প্রাপ্তিতে মালেক ভাইকে আবারো অভিনন্দন । তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি ।
লেখক: বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

পূর্ববর্তী নিবন্ধমালেক ভাই ও দৈনিক আজাদী
পরবর্তী নিবন্ধঅনন্য সম্পাদক এম এ মালেককে জানাই অকুণ্ঠ শুভেচ্ছা