১৮৬২ সালে উইলিয়াম বার্টন রজার্স ম্যাচাচুয়েটস্ চার্লস নদীর তীরে পলিটেকনিক স্কুলটি প্রতিষ্ঠার সময় কতটুকু স্বপ্ন দেখেছিলেন তা জানার আজ আর কোন সুযোগ নেই। কালক্রমে এটি পরিণত হয় ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এটি হয়ে উঠেছিল সমরবিদদের শীর্ষ গবেষণাকেন্দ্র। স্নায়ুযুদ্ধ সময়কালের মহাকাশ প্রতিযোগিতা এবং আমেরিকার বর্তমান একচেটিয়া কর্তৃত্ব মানব সভ্যতাকে যেখানে নিয়ে গেছে তা একাধারে বিষ্ময়কর, রোমাঞ্চকর এমনকি ভয়ঙ্কর সুন্দর।
আমরা বোস্টন পৌঁছেছি ২০ ডিসেম্বর ২০২৩। রাতেই সেলিম এসে হাজির। পুরো নাম সেলিম জাহাঙ্গীর। আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক এই বন্ধু ছোটবেলা থেকে বঙ্গবন্ধু প্রেমিক। জড়িয়ে ধরল জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে। বুঝলাম, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে বটে। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকবেন, যতদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র থাকবে। জাতির পিতা হিসেবে জীবিত থাকবেন যতদিন বাংলা এবং বাঙালী জাতিসত্তা বিলীন না হবে।
সিটি কর্তৃপক্ষ অনুপমের শ্বশুড় শ্বাশুড়ীর জন্য একটি স্টুডিও এপার্টমেন্ট বরাদ্দ করেছে। ফ্ল্যাটটি খালি। অনুপম ঐ ফ্ল্যাাটে নিয়ে চলল। ডিনার শেষে সেলিম ভোঁ করে গাড়ী নিয়ে উধাও। সকালের খাবার পরটা, ডিম, দুধ নিয়ে হৈ চৈ করে ঢুকে বলল, নাস্তা করে ৯ টার মধ্যে রেডি থাকবি। ৯টা থেকে ১টা পর্যন্ত এম আই টি ক্যাম্পাসে থাকবো। রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে ভাবছিলাম পলিটেকনিক থেকে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়টি র্যাঙ্কিং এ কখনো প্রথম কখনো হার্বাড প্রথম। এম আই টি থেকে আজ পর্যন্ত মহাশূন্যে হানা দিয়েছে ৩৪ জন মহাকাশচারী। সব’চে গর্বিত নভোচারী হলেন বাজ অলড্রিন। যিনি এপোলো ১১ চন্ত্রযানের কমাণ্ড মডিউলে বসে দু’নয়ন ভরে দেখছিলেন নীল আর্মস্ট্রং আর মাইকেল কলিংস এর রূপসী কন্যা চন্দ্রপৃষ্ঠে পদচারণা। মডিউলটি ওয়াশিংটনস্থ নাসা মিউজিয়ামে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।
সেলিম বোস্টনে এসে দুর্দান্ত ড্রাইভিং রপ্ত করেছে। ঘড়ির কাঁটায় ঠিক সাড়ে ৯টা, তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। আলোর বন্যায় ক্যাম্পাসের পাতায় পাতায় মৃদু নাচন। চার্লস নদীর উত্তর তীরে ১৬৮ একর জায়গার উপর গড়ে উঠা এই জ্ঞানমন্দির প্লাবিত হয় নদীর মিষ্টি বাতায়নে। বৃটিশরা আটলান্টিক পাড়ী দিয়ে চার্লস নদী ব্যবহার করেই বসতি শুরু করেছিল আমেরিকা মহাদেশে। রেড ইন্ডিয়ানদের ঠেলতে ঠেলতে পাঠিয়ে দিয়েছিল গহীন অরণ্যে। আমেরিকা মহাদেশে রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে বৃটিশ নিকৃষ্টতম আচরণ করেছে। বিলাসিতার নীল উৎপাদনের জন্য এদেশের কৃষকদের করেছে সর্বস্বান্ত। ডাণ্ডির মেশিনে তৈরী বিলেতী কাপড় বাজারজাত করার জন্য ঢাকাইয়া মসলিন ও ভারতবর্ষের তাঁতীদের নিঃস্ব করার জন্য বৃটিশ যে অত্যাচার করেছে তার চেয়ে হাজারগুণ নিষ্ঠুরতায় ভরা ছিল রেড ইন্ডিয়ান বিরোধী অভিযান।
অথচ সাইবেরিয়ার তীব্র শৈত্যপ্রবাহ থেকে বাঁচার জন্য দশ হাজার বছর আগে রেড ইন্ডিয়ানরা হাজার হাজার মাইলের বরফাচ্ছাদিত পথ অতিক্রম করে আমেরিকা নামক অনিন্দ্য সুন্দর এক ভূ–খন্ডে হাজির হয়ে বাঁচার স্বপ্নে হয়েছিল বিভোর। অথচ এই স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে তথাকথিত সভ্য বৃটিশ। বন্দী নবাব সিরাজ–উদ–দৌলাকে টুকরো টুকরো করে হাতির পিঠে চাপিয়ে শহর ঘুরানোর নৃশংসতার কোন মানে হয় না। এ খবর বৃটিশ জাতির মনস্তাত্ত্বিক জগতে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। পার্লামেন্টারী কমিটি ক্লাইভকে তলব করলো। পরিণতি টের পেয়ে ক্লাইভ মাথায় নিজের রিভলভার ঠেকিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
এম.আই.টি’র মূল প্রশাসনিক ভবন “বিল্ডিং ১০” হলো অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের আমেরিকান স্থাপত্য সৌন্দর্য্য ও সৌকর্য্যের প্রতিক। প্রবেশদ্বারের একেকটি সিড়ি অতিক্রম করার সময় যে কোন শিক্ষার্থীর মনন জগতে জ্ঞানের নেশা লাগবেই। যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা, প্রকল্প ও প্রস্তাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে গুরুত্ব দিতে হবে একেবারে শুরুতে। শুরু মানে প্রবেশ ভবনের প্রবেশ দ্বার। আমেরিকার বহু জায়গায় গিয়েছি। ঊনবিংশ শতকের আমেরিকান স্থাপত্যের বিশেষ ঘরানার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় দেশটির সেরা হবার আকাঙ্ক্ষা। বিগত ১৬০ বছরে নয়ন মনোহর এই দ্বার ঠেলে ঢুকে পড়া আণ্ডার গ্রাজুয়েটরা বেরিয়েছে জ্ঞানের প্রদীপ হাতে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৩ পর্যন্ত নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা ১০১।
এম আই টি’র প্রতিষ্ঠাতা বার্টন রজার্স সম্পর্কে কিছু না বললে অপূর্ণতা থেকে যায়। গৃহযুদ্ধে হতোদ্যম, বিধ্বস্ত, অবিন্যস্ত আমেরিকার সামনে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প ছিল না। রজার্স বললেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া উন্নতির দ্বিতীয় কোন পন্থা নেই। বিশাল আমেরিকাকে প্রথমে বিস্তৃত সড়ক ও রেলপথ অবকাঠামোর অধীনে আনা চাই। প্রয়োজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। কৃষিতে আধুনিক ট্রাক্টর, বীজ ও সেচ প্রকল্প দরকার। চাই মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। আমেরিকান জনগণের একটি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা দরকার। সৃষ্টি করা দরকার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার। ভার্জিনিয়ার অধ্যাপনা জীবন ত্যাগ করে ১৮৫৩ সালে বোস্টনে পদার্পণ করেই একটি টেকনিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিজ্ঞান জার্নালে লিখতে থাকলেন একের পর এক প্রযুক্তি সংক্রান্ত নিবন্ধ। তার পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে ম্যাচাচুয়েটস্ শহর কর্তৃপক্ষ রজার্সকে গ্যাস ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ করেন এবং এই পদে থেকেই প্রতিষ্ঠা করলেন ম্যাচাচুয়েটস্ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি। ম্যাচাচুয়েটস্ সংসদ রজার্সকে প্রতিষ্ঠানের প্রথম প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগ দিলে খুলে যায় ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাতিঘরের প্রশস্ত দরজা। ১৮৭০ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট (ভিসি) পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৮২ সালে মৃত্যুর পূর্বে রজার্স হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর এমআইটি একদিন বিশ্বসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হবে।
বোস্টন শহরটিকে বিদ্যানগরী বললে বেশী বলা হয় না। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে হার্বাডের ক্যাম্পাসে ঢুকে গেলাম বুঝলাম না। বাস্তবতা হলো এখন এমআইটি আর হার্বাড ক্যাম্পাসের মধ্যে সীমান্ত রেখা পাওয়া মুশকিল। বিষয়টি বার্টন রজার্সের জীবদ্দশাতেই অনুভূত হয়েছিল। ১৮৬১ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত অন্তত ৬ বার বিশ্ববিদ্যালয় দু’টো একত্রীকরণের উদ্যেগ নেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ম্যাচাচুয়েটস্ সুপ্রীম কোর্ট ঘোষণা করে, অদুর ভবিষ্যতে কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় দু’টোকে এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যাবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এমআইটি’কে গবেষণার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডারে দেশের সমস্ত বিজ্ঞানীদের এম আই টি’তে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, যেন দ্রুত উন্নত যুদ্ধ বিমান তৈরী হয়। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল উন্নত যুদ্ধ হেলিকপ্টার, মাইক্রোওয়েভ রাডার, উন্নত ডিনামাইট অস্ত্র এম আই টি’র বিজ্ঞানীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। সামরিক উদ্দেশ্য নিয়েই আইনস্টাইন লন্ডন ছেড়ে আমেরিকায় হাজির হয়ে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে পত্র মারফত পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সংক্ষিপ্ত প্রস্তাব পেশ করেন। পারমাণবিক বোমা তৈরীর প্রস্তাবটি রুজভেল্টকে ভীষণভাবে প্ররোচিত করে। তবে জার্মান নাগরিক বিধায় প্রেসিডেন্ট আইনস্টাইনকে দায়িত্ব না দিয়ে, দিলেন আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারকে। তিনি এম আই টি থেকে স্বপরিবারে শতাধিক বিজ্ঞানী নিয়ে হাজির হলেন ম্যানহাটন প্রজেক্টে। আইনস্টাইন প্রস্তাবিত এটম বোমা দিয়ে ধ্বংস করা হয় হিরোশিমা ও নাগাশাকি। ওপেন হাইমার গীতার উদ্বৃতি দিয়ে বলেছিলেন আমি আজ বিশ্ব ধ্বংস করতে সক্ষম। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রুজভেল্টকে ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মারণাস্ত্র তৈরীর নির্দেশ দিয়ে একই কুকর্ম করেছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরি গ্যাগারিনকে মহাশূন্যে পাঠালে শুরু হল দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধ। এর জবাবে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট এফ কেনেডি ইউনিয়ন ভাষণে বিজ্ঞানীদের চাঁদে যাবার প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলে এম আই টি আবার মোমবাতির শিখা শিখরে চলে আসে। এম আই টি’র গ্রাজুয়েটরা ‘নাসা’ কে পরিণত করল মহাকাশ বিজ্ঞানের মানমন্দিরে। ভাবতে অবাক লাগে এম আই টি বিজ্ঞানীরা খুঁজে চলেছে ব্রহ্মাণ্ডের কোন গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা? খুঁজে চলেছে ঠিক কত বছর কত দিন কত ঘন্টা আগে বিগ ব্যাং সংঘটিত হয়েছিল। এবার শুরু হয়েছে অও (কৃত্রিম বুদ্ধিবৃত্তিক) প্রযুক্তি নিয়ে পরিকল্পিত উম্মাদনা। গত বছর বিল গেটস্ একাই দিয়েছেন ২০ মিলিয়ন ডলার। ওইগ ঘোষণা দিয়েছে আগামী একদশকে প্রতিষ্ঠানটি ২৪০ মিলিয়ন ডলার MIT কে অনুদান দেবে। ক্যাম্পাস ত্যাগ করে ভাবছিলাম, পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো কোনদিন হাজির হয়ে যাবে ভিন গ্রহে। সেখানে ঘর বাঁধবে। সংসার হবে। এই সাফল্যে পৃথিবীর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে ধ্বনিত হবে এম আই টি ও তার প্রতিষ্ঠাতা বার্টন রজার্সের নাম।
লেখক: আইনজীবী, আপিল বিভাগ; কলামিস্ট