এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য একটি বড় ধরনের সুখবর দিলেন মাননীয় বিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। শিক্ষকদের উৎসব ভাতা, বিনোদন ভাতা, বাড়ি ভাড়া সহ অন্যান্য ভাতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টার এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ তা নির্দ্ধিধায় বলা যায়। সরকারি–বেসরকারি নামক শিক্ষা ব্যবস্থায় চরম বৈষম্যের শিকার এমপিওভুক্ত শিক্ষক–কর্মচারীদের দীর্ঘ দিনের দাবীর বাস্তবতা উপলব্ধি করে দেরীতে হলেও তিনি যে আশার বাণী শুনিয়েছেন তার জন্য মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ কৃতজ্ঞ।
বিগত ৫ মার্চ ২০২৫ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদকে বিদায় এবং সি আর আবরারের যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ভাতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘কয়েক মাস আগেই আমি সবাইকে আশ্বাস দিয়েছিলাম, সাধ্যমত এ বছর এবং আগামী বছরের বাজেটে যতটুকু অর্থ সংকুলান করা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসে আমরা যতদূর পারি চেষ্টা করব বেসরকারি শিক্ষকদের দাবিগুলো মেটাতে’। উপদেষ্টা বলেন, ‘কিন্তু, ১৫/২০ বছরের বঞ্চনা ১/২ বছরের বাজেট দিয়ে তো মেটানো যায় না। এটা বোঝানো খুব কঠিন। আজকেই বেসরকারি বেতন সরকারি বেতনের সমান করে দিতে হবে– এটা ন্যায্য দাবি বুঝলাম, কিন্তু এক বছরের বাজেট দিয়ে কীভাবে ১৫ বছরের বৈষম্যে ঠিক করা যায়? কিন্তু শুরুটা করা দরকার। সেই শুরুটা আমরা করে দিয়ে যাচ্ছি’।
ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব ভাতা, বিনোদন ভাতা, বাড়ি ভাড়া চিকিৎসা ভাতা–এ বছরের ঈদুল আযহা থেকে শুরু করে আগামী বছরের বাজেট থেকে অন্তত কিছু বাড়াতে পারবো, এখানেও আমি ঘোষণা দিচ্ছি না কত বাড়াবো। আমি জানি সেটুকু বাজেটের মধ্যে এ বছর এবং আগামী বছরের বাজেটের মধ্যে প্রভিশন রাখা হচ্ছে’। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের দাবী দাওয়ার প্রতি মাননীয় বিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টার সুচিন্তিত এহেন মহতী উদ্যোগ এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় যেন কোনো ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি না হয়, সে প্রত্যাশা শিক্ষক সমাজের। একজন শিক্ষক বান্ধব মানুষ হিসেবে বেসরকারি শিক্ষকদের মনের বেদনা তিনি যে উপলব্ধি করে দায়িত্ব ছাড়ার শেষ দিনে নতুন যোগদান করা শিক্ষা উপদেষ্টা জনাব সি আর আবরারকে সামনে রেখে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন– তার জন্য তিনি (ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ) শিক্ষকদের মানসপটে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। বহুদা বিভক্ত শিক্ষক সংগঠনের অনৈক্যের ফলে বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনের আকুল আবেদন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট মহলে যথাসময়ে না পৌঁছানোর কারণে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দিনের পর দিন বঞ্চনার শিকার হয়েছেন বলে সচেতন নাগরিকদের ধারণা।
সদ্যবিদায়ী শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বেসরকারি শিক্ষকদের পেনশনের ৬–৭ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যাংকে টাকাগুলো রাখা হয়েছিল সেটির কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। এর ফলে এখন পেনশনের তহবিলটি খুব সম্ভব শূন্যের কোটায় দাঁড়িয়েছে। এই দুঃসংবাদটি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক–কর্মচারী, যারা ৪/৫ বছর ধরে অবসরের টাকা হাতে হাতে পাওয়ার জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় আছেন, তাদের মাথায় বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতো পড়েছে। পেনশনের হাজারো কোটি টাকা লুটের সংবাদ প্রকাশের পরই শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিদায় নেন। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক–কর্মচারিদের জন্য আক্কেপ করে বলেন, ‘তারাতো সংগঠিত নয়, তাদের কোনো সংগঠনও নেই– আমি ভেবেছিলাম তাদের দাবীটাই অগ্রাধিকার পাবে। তাদের জন্য একটা ফান্ড করে দিয়ে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে সমস্যাটি দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি’। ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য নিরেট উপযুক্ত একজন উপদেষ্টা। অধিকন্তু, বিগত কয়েক মাসে তিনি বেসরকারি শিক্ষার ক্ষতগুলো এবং শিক্ষকদের দাবি দাওয়া সম্পর্কে অনেক কিছু অবগত হয়েছেন।
শিক্ষার ক্ষত এবং শিক্ষকদের সমস্যা দূরীকরণে তিনি ব্যক্তিগত কিছু নির্দেশের কথা জানিয়েছেন। বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি–দাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু, হঠাৎ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সরে যাবার কারণে তার নির্দেশনাগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা–তা নিয়ে শিক্ষক সমাজ উদ্বিগ্ন। যে সব দাবি–দাওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন, সেগুলোও এখন অনিশ্চিত বলা চলে। এখন যিনি এসেছেন তিনিও খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ বটে। কিন্তু, শিক্ষার ক্ষত এবং শিক্ষকদের সমস্যাবলি অবহিত হতে তার আরো কয়েক মাস সময় লাগবে। নিজস্ব পর্যবেক্ষণ ও এসবের সমাধান খুঁজতে আরো অনেক সময় দরকার। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে এতো বেশি সময় আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং বর্তমান সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই পরিবর্তন শিক্ষা এবং বেসরকারি শিক্ষক–কর্মচারীদের জন্য নিঃসন্দেহে বড় দুঃসংবাদ বটে। শিক্ষক–কর্মচারীদের প্রতি মাসের বেতন থেকে কর্তন করা ১০% টাকা যা অবসরকালীন কিছু সরকারি বরাদ্দসহ শিক্ষক–কর্মচারীরা প্রাপ্য হতেন, তাও লুট–পাটের খবরে তাদের মধ্যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় স্বাভাবিকভাবে হতাশা বিরাজ করছে। এমনিতেই, প্রচলিত পদ্ধতিতে অবসর ও কল্যাণ ভাতা প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে ন্যায্য পাওনার আগেই অনেক শিক্ষক–কর্মচারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তার উপরে তাদের জমানো টাকা উধাও হওয়ার খবর বেসরকারি শিক্ষক–কর্মচারীদের মনে আতংকের সৃষ্টি করেছে। আশাকরি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ বিষয়টির সমাধানে সচেষ্ট হবেন।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কোনোদিন ব্যর্থ হয়নি। ব্যর্থ হতে পারে না। শিক্ষকদের বিভাজিত আন্দোলন কাম্য নয়। চাই সম্মিলিত ও সমন্বিত শিক্ষক আন্দোলন। এতে করে শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান যেমন বাড়বে, তেমনি শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত দাবি–দাওয়া পুরণ করতে যে কোনো সরকার বাধ্য হবে। হোক সে রাজনৈতিক কিংবা অন্তর্বর্তী যেকোনো ধরনের সরকার। বর্তমান বিশেষ ধরনের সকারের হাতে শিক্ষার সব বৈষম্য এবং বেসরকারি শিক্ষকদের সব দুর্গতির অবসান হোক– এটিই প্রতাশা।
লেখক : প্রধান শিক্ষক, উরকিরচর উচ্চ বিদ্যালয়, রাউজান, চট্টগ্রাম।