আমরা প্রতিদিনই কোনো না কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত সংবাদের মুখোমুখি হই। আমাদের পড়তে হয় মানুষের অনেক অসহনশীল আচরণের খবর। ২৪মে দৈনিক আজাদীতে শিরোনাম হয় ‘আইসক্রিমের লোভ দেখিয়ে শিশুকে ধর্ষণ, চাচা গ্রেপ্তার’। অন্যদিকে ২২ মে প্রকাশিত হয় আরেকটি সংবাদ। শিরোনাম ‘আনোয়ারায় গার্মেন্টস কর্মীকে ধর্ষণ, প্রেমিকসহ গ্রেপ্তার ৩’।
বিস্তারিত তথ্যে জানা যায়, সাতকানিয়ায় আইসক্রিমের লোভ দেখিয়ে পাঁচ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে তার প্রতিবেশী। গত শনিবার রাতে সাতকানিয়া পৌরসভার ভোয়ালিয়া পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। গত সোমবার দিবাগত রাতে কঙবাজার থেকে অভিযুক্ত মো. শহীদুল ইসলামকে (৩১) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার শহীদুল সাতকানিয়া পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের ভোয়ালিয়া পাড়ার মৃত নুরুল আমিনের ছেলে। ভিকটিম শিশুর মা বলেন, গত শনিবার রাতে আমার মেয়ে হঠাৎ কেক খেতে চায়। তখন মেয়েকে তার জেঠাত বোনের সাথে কেক আনার জন্য পাশের তৌহিদুল ইসলামের দোকানে পাঠাই। কেক নিয়ে ফেরার পথে আমার প্রতিবেশী দেবর মো. তৌহিদুল ইসলাম আইসক্রিম খাওয়ানোর কথা বলে মেয়েকে রেখে দেয় এবং তার জেঠাত বোনকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ঘটনার কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে আমার মেয়ে বাড়িতে এসে ব্যথা লাগার কথা জানায়। তখন দেখি মেয়ের প্যান্ট রক্তাক্ত অবস্থায়। পরে মেয়ের মুখে সব কিছু শোনার পর তাকে দ্রুত সাতকানিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাই। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চমেক হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) প্রেরণ করেন। মেয়ে এখনো সেখানে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এটা বলা যায় যে স্বার্থচিন্তা, অসংযত লোভ এবং নানা ভেদজ্ঞানই হয়তো মানুষকে ক্রমাগত সংকীর্ণ ও অসংযত হওয়ার পথে ঠেলতে ঠেলতে চরম অসহনশীল করে তুলেছে। সহনশীলতা একটি সামাজিক মূল্যবোধ এবং এটা মানুষের একটি গুণ। অবশ্য সব মানুষের মধ্যে এই গুণ দেখা যায় না। কেউ হয়তো জন্মগতভাবে বা পারিবারিক অনুশাসনের মাধ্যমে এই গুণের অধিকারী হয়, আবার কেউবা শিক্ষার মাধ্যমেও এটা আয়ত্ত করতে পারেন বা করেন। এই গুণের চর্চাও বিভিন্ন পর্যায়ে হতে পারে। পরিবারে, প্রতিষ্ঠানে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে এবং রাষ্ট্রের বৃহত্তর পরিসরে সহনশীলতার চর্চা কিন্তু অপকারের চেয়ে উপকারই বেশি করে।’
উল্লেখ্য, দেশে সার্বিক অপরাধপ্রবণতার কোনো একক চিত্র পাওয়া যায় না। নেই কোনো সমন্বিত জরিপও। এরপরও সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য এবং বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্য–উপাত্তের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, যৌতুক, মাদক, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব কাজ করছে। পরিবারে শারীরিক–মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবারে ব্যক্তির মানসিক সমস্যাগুলো সেভাবে চিহ্নিত করা হয় না। এ কারণে তারা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছেও যান না। ফলে মানসিক সমস্যা ও সমাজের বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। তবে পরিতাপের বিষয়, সমাজ ও পারিবারিক পর্যায়ে সংঘটিত সহিংসতার সঠিক চিত্রটি অজানা, যা অনভিপ্রেত।’ তাঁদের মতে, শুধু আইন থাকলেই হবে না; সে আইন বাস্তবায়ন জরুরি। দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা অপরাধ না কমে আরো বাড়বে বৈকি। আইন থাকলেও অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা থানা–আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। বেশির ভাগ ঘটনাই স্থানীয় সালিসে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু এই সমঝোতার বৈঠকেও ঘটলো নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এই সহিংসতা আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর ফল। এর থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। আর এটি করতে না পারা মানবিক এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।
শিশুরা নিষ্পাপ। শিশুদের দেখলে এক ধরনের মায়া জন্মে। জগতের অন্য অনেক না পাওয়া, হতাশা ভুলিয়ে দেয় শিশুর নিষ্পাপ মুখ, তার অমলিন হাসি। সেই শিশুরা যখন নির্মম নৃশংস হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়–এরচেয়ে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে। আসলে শিশুধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা আমাদের চরমভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। শিশুর প্রতি সহিংসতা ও শিশু হত্যার মতো ঘটনা অমানবিক। এ থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।