মাদক এবং পরিবেশ দূষণ বন্ধে সবাই সোচ্চার না হলেও দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী চায় দেশে মাদক নির্মূল হোক, রক্ষা হোক আমাদের পরিবেশ, বিভিন্ন পরিবেশ দূষণের মধ্যে অন্যতম একটি পরিবেশ দূষণ হচ্ছে শব্দ দূষণ। প্রতিটি ধর্মেই মাদক এবং যে কোনো ধরনের দূষণ থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ধর্মের বিধি নিষেধ থাকলেও আমাদের দেশে আমরা লক্ষ্য করছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাদক এবং শব্দ দূষণকে পরিহার করার পরিবর্তে ব্যবহারে যেন উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এবং কিছু মানুষের অনৈতিক এই কর্মকাণ্ডের ফলে অনেকেই আবার গড় পড়তা এর সমালোচনা করছে। কোনো ধর্ম বা কোনো মহান সাধক বা ধর্ম প্রচারক কখনো মাদক গ্রহণ বা সমাজের জন্য ক্ষতিকর কোনো বিষয় তাদের কোনো কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত হোক সেটি চায় না কিছু অবিবেচক মানুষ নিজস্বার্থে এগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। এবং এসব অনাচার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এমনকি সমাজে সেগুলো বন্ধে আমরা অনেকটা নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছি।
বাংলাদেশের বাউল সম্্রাট লালন শাহ, কেউ ডাকে গুরুজি কেউবা বলেন সাইজী। লালনের প্রকৃত নাম ললিত নারায়ন কর হলেও ব্যক্তি জীবনে তিনি কোন ধর্মকে অনুসরণ করেননি, তার সাধনার জায়গা হচ্ছে দেহতত্ত্ব। তিনি দেহতত্ত্বকে ধারণ করে মানবধর্মকে যে কোনো ধর্মের চেয়ে বড় করে দেখেছেন। তিনি শুধু একজন বাউল সাধক ছিলেন না, ছিলেন একজন গবেষক এবং গীতিকার। লালন শাহের বাউল সংগীত আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তাই তিনি বাংলার বাউল সম্রাট হিসেবে সমাদৃত। দেহতত্ত্বের ধারক হিসেবে লালনের অনুসারীরা কোনো জনপ্রিয় শাস্ত্রীয় ধর্ম মানে না এদের জীবন যাত্রা স্বাভাবিক মুসলমান বা হিন্দুদের মত নয়। এই কারণে লালনের শেষকৃত্য কোনো ধর্ম মতে হয়নি বলে জানা যায়। লালন শাহের মৃত্যুর পর ভক্তরা কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়া গ্রামে একত্রিত হতে থাকে, কালের পরিক্রমার বহু দর্শানার্থী সমাগমের ফলে লালন শাহের সমাধিক্ষেত্রটি আজকে লালন শাহ’র মাজার বা লালন আখড়া হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতিবছর ১ লা মার্চ থেকে ৩ রা মার্চ এবং ১৭ই অক্টোবর থেকে ২৯ শে অক্টোবর ছেউড়িয়াতে বসে লালন মেলা যাতে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাউলরা এমনকি অনেক বিদেশীরা এই মেলায় অংশগ্রহণ করে। বাউল সংগীত চর্চা আমাদের সংস্কৃতিকে নতুন মাত্রা যোগ করলেও এই লালন মেলায় সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়টি হচ্ছে সিদ্ধি বা গাঁজার অত্যাধিক ব্যবহার যা একটি ভালো অনুষ্ঠানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে লালন কখনো মাদক গ্রহণ বা মাদক গ্রহণের কথা বলেছেন কিনা তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই। তাদের এই অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্যই অনেকেই লালন শাহ বা দেহতত্ত্ব বা বাউলদের নিয়ে কটুক্তি করে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
ইসলামে হাক্কানী পীর ওলামাদের সংস্পর্শে থেকে আল্লাহ–রসুলের পথে চলার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামের প্রচার এবং বিস্তারের ইতিহাস পড়লে জানা যায় এই পীর মাশায়েখরা এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশ কিছু মাজারেও পীরের মুরীদ, পাগল, ফকির এসব বলে এক শ্রেণির মাদকসেবীদের বিচরণ করতে দেখা যায়। যার ফলে এদের বিতর্কিত এই কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো মাজার বা পীরকেও অনেকেই বিতর্কিত করে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে কয়েকটি ধারার মতবাদ প্রচারিত আছে। একটি পক্ষ মাজার এবং পীর মাসায়েকদের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের অনুসারীদের মাজার পূজারী, শিরক, বেদাত বলে গড়পড়তা বক্তব্য উপস্থাপন করছে, অন্যদিকে অন্য পক্ষ যারা পীর মাসায়েখদের বিরোধিতা করছে তাদের নবী বিরোধী বলে বক্তব্য উপস্থাপন করছে এতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিভিন্ন ধারার অনুসারী হিসেবে বিভক্ত হয়ে পড়ছে, ফলে আমরা অনেক সময় ধর্মের মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে সেটিকে হানাহানিতে পরিণত করছি। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে মাজার সমূহে অনেক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য একটি পক্ষ অনেক মাজার ভেঙে দেয়ার মত ধর্ম বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে, কিন্তু ইসলাম ধর্মে কোনো মৃত ব্যক্তির কবরে আঘাত করার মত কোনো অধিকার ধর্ম কাউকে প্রদান করেনি। এই যে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন অনুসারী হিসেবে বিবেধ তা অবশ্যই সমাজ এবং ধর্মের জন্য ক্ষতিকর।
বাংলাদেশে আমরা অন্য একটি বিষয় প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করছি যে বিভিন্ন মাহফিল এবং বিভিন্ন পূজা অর্চনায় অত্যধিক আওয়াজে মধ্য রাতব্যাপী অনুষ্ঠান এর আয়োজন করছে এবং সেখানে অতিরিক্ত আওয়াজে বিভিন্ন ধরনের সাউন্ড বক্স ও মাইক ব্যবহার করছে যা শব্দ দূষণ করছে। এই শব্দ দূষণের মাত্রা এতটা প্রকট ও মারাত্বক যে আয়োজকরা এতে সমাজের বিভিন্ন মানুষের পারিপার্শ্বিক যে অসুবিধা হচ্ছে তার কথা সামান্য চিন্তাও করে না। মাহফিল বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে কোনো বাধা বা সমস্যা নেই কিন্তু অনুষ্ঠানের নামে সারারাত মানুষকে যে কষ্ট দেওয়া হয় বা এর জন্য সমাজে ধর্ম নিয়ে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে তা নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। প্রকৃত পক্ষে কোনো ধর্মেই এই মধ্যরাতে এইরূপ শব্দ দূষণ সমর্থন করে না।
সমাজে বলুন, ধর্মে বলুন কিছু বিষয়ে আমরা সংযোজিত করি যার প্রকৃত অর্থে কোনো প্রয়োজন নেই বরং সেই সংযোজিত বিষয়ের কারণে মূল বিষয়টি হয়ে পড়ে গৌণ এবং সেটির জন্য একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার এবং সমালোচনার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে মাদক নির্মূলে সরকার জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে, পরিবেশ আন্দোলনকারীরা এই শব্দ দূষণ বন্ধে কাজ করছে, কিন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায় না। তবে এসব বন্ধ করতে হলে আয়োজকদের আগে নিজেদের সচেতন থাকতে হবে যাতে উক্ত অনুষ্ঠানের জন্য সমাজ, রাষ্ট্র বা ধর্ম প্রশ্নবিদ্ধ না হয়, প্রয়োজনে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতা তারা গ্রহণ করতে পারে। প্রত্যেকেরই ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাসকে রক্ষা করার জন্য পরিহার করতে হবে অপ্রয়োজনীয় সব আয়োজন, হতে হবে প্রকৃত ধার্মিক এবং সংস্কৃতিপ্রেমী, নিজেদের পরিচালিত করতে হবে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসনে।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।