চট্টগ্রাম ওয়াসার কোটি কোটি টাকার জমি ভুয়া ছাড়পত্রের মাধ্যমে আত্মসাতের চেষ্টা করা হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ জমির একটি ভুয়া ছাড়পত্র ধরা পড়ার পর ওয়াসা প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। ওয়াসার এমডির সিল স্বাক্ষর জাল করে প্রায় দুই একর জমির ছাড়পত্রটি তৈরি করা হয়। ঘটনার ব্যাপারে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রশাসনের পক্ষে হাটহাজারী থানায় একটি মামলা রুজু করা হয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসা, পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর বিস্তৃত এলাকায় পানির যোগান দেয়া একমাত্র সংস্থা চট্টগ্রাম ওয়াসা নিজেদের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় ভূমি হুকুমদখল করে। সরকারি নিয়মে এলএ (ল্যান্ড একুইজিশন) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওয়াসা এসব জমির মালিকানা লাভ করে। কিন্তু হুকুমদখলকৃত জমিতে দীর্ঘদিন কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন না করায় সংঘবদ্ধ চক্র ওই জমি নানা জালিয়াতির মাধ্যমে দখল নেয়ার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন স্থানে ওয়াসার অনেক জমিই এভাবে দখল হয়ে রয়েছে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার নামে এলএ মামলা নম্বর– ২৫৬ (১)/১৯৬২–৬৩ ইং ও ২৫৬(২)/১৯৬২–৬৩ ইং মূলে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানাধীন দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার বিভিন্ন দাগে ৫০ একর এবং চিকনদন্ডী মৌজার বিভিন্ন দাগে ২৫ দশমিক ৭৬ একর মিলে সর্বমোট ৭৫ দশমিক ৭৬ একর জায়গা হুকুম দখল করে। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াসার এই বিপুল পরিমাণ ভূমি অরক্ষিত অবস্থায় ছিল।
গত বেশ কিছুদিন ধরে চট্টগ্রাম ওয়াসা উক্ত ভূমিতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পয়ঃনিষ্কাশন কেচম্যান–৩ প্রকল্প স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রকল্প এলাকার চারদিকে সীমানা দেয়াল নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু গতকাল ওয়াসা কার্যালয়ে এসে ৮ কানি দুই গন্ডা (এক একর ৯৪.৪ শতক) ভূমির ব্যাপারে প্রদত্ত একটি ছাড়পত্র পেয়ে ওয়াসা প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। চিকনদন্ডী মৌজার ৮ কানি ২ গন্ডা জায়গার উক্ত ছাড়পত্রটি ইস্যু দেখানো হয়েছে গত ২৬ ডিসেম্বর।
চট্টগ্রাম ওয়াসার স্মারক নম্বর–৪৬.৩৯.০০০০.১০৬.৪৬. ৮০. ২৮ মূলে দেয়া উক্ত ছাড়পত্রে ফতেয়াবাদ চিকনদন্ডী মৌজার বেশ কয়েকটি দাগ উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, ‘এসব দাগের ৮ কানি দুই গন্ডা জমির বি এস খতিয়ানে নামজারী ও খাজনা ২০২৪ সাল পর্যন্ত পরিশোধ করা আছে। এই খতিয়ান ও দাগ নম্বরে আমাদের চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের কোনো জমি নাই। প্রকৃত জমির মালিক উপরে উল্লেখিত ব্যক্তিরা স্থায়ী জমির মালিক। তাই চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ সেই জমি কোনো দাবিনামা করবে না। এই মর্মে ছাড়পত্র প্রদান করিলাম।’– ছাড়পত্রে স্বাক্ষর করেন চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার পাশা। ছাড়পত্রটির ব্যাপারে খোঁজ নেয়ার জন্য ওয়াসা কার্যালয়ে আসলে তদন্ত করে দেখা হয় যে, উক্ত স্মারকে এই ধরনের কোনো চিঠি ইস্যু হয়নি। ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার পাশা এই ধরনের কোনো ছাড়পত্র ইস্যুও করেননি। তার জাল স্বাক্ষর ও সিল ব্যবহার করে ছাড়পত্র ইস্যু করে জমির মালিক সেজে বিক্রি করার চেষ্টা করা হচ্ছিল। ক্রেতারা যাচাই করতে গিয়েই ব্যাপারটি ধরা পড়ে। যদি ওই ক্রেতা ছাড়পত্র যাচাই না করে জায়গাটি কিনে নিতেন তাহলে বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হতেন বলেও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। বিষয়টি ধরা পড়ার সাথে সাথে চট্টগ্রাম ওয়াসা প্রশাসন বৈঠক করে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ওয়াসার এস্টেট অফিসারের দায়িত্বে থাকা সহকারী সচিব মোহাম্মদ বাবুল আলম বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় একজনের নামোল্লেখ এবং অপরাপর ১০/১৫ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংঘবদ্ধ একটি ভূমিদস্যু ও জালিয়াত চক্র ওয়াসার মালিকানাধীন ভূমির ভুয়া মালিক সেজে ভুয়া ছাড়পত্র সৃজন ও দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের এসব ভূমি বিক্রি ও হস্তান্তরের চেষ্টা করছে। এজাহারে উল্লেখ করা হয় যে, চট্টগ্রাম ওয়াসা এসব সম্পত্তির নিরঙ্কুশ মালিক ও দখলকার হলেও বিএস রেকর্ডে ভুল থাকায় কিছু ব্যক্তি বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণার চেষ্টা করছে।
এই ব্যাপারে ওয়াসার আইন উপদেষ্টা এডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, একটি জালিয়াত চক্র প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। তারা ওয়াসার মালিকানাধীন মূল্যবান ভূমি ভুয়া ছাড়পত্রের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। আমরা আইনি পদক্ষেপ নিয়েছি।
ওয়াসার সহকারী সচিব মোহাম্মদ বাবুল আলম ঘটনার কথা স্বীকার করে বলেন, আমি নিজে থানায় গিয়ে এজাহার দিয়ে এসেছি। পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নেবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। চাকরি জীবনে তিনি এই ধরনের প্রতারণা আর কখনো দেখেননি উল্লেখ করে বলেন, ওয়াসার এমডি চট্টগ্রামের আরো অনেকগুলো সংস্থার সাথে জড়িত। ওনার নাম ব্যবহার করে এই ধরনের প্রতারণা অবিশ্বাস্য। আরো কেউ এই ধরনের কাজের সাথে জড়িত রয়েছে কিনা তাও খুঁজে বের করা হবে।
হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাউসার হোসেন বলেন, আমরা একটি এজাহার পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে।
চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি মোহাম্মদ কামাল পাশা দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘আমার সিল–স্বাক্ষর জাল করে তথাকথিত একটি ছাড়পত্র তৈরি করে প্রতারণার চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি ধরা পড়েছে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই হাটহাজারী থানায় চট্টগ্রাম ওয়াসার পক্ষ থেকে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আরো কিছু আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’