এভারেস্ট ক্ষ্যাপাটে

ফরহান জামান | সোমবার , ২২ জুলাই, ২০২৪ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

পূর্ববর্তী সব একাকী অভিযাত্রীদের অনুনোমোদিত অভিযানে ছিল এভারেস্টের উত্তর দিক থেকে। সে ১৯৩৪ সালে মৃত ব্রিটিশ মরিস উইলসন হোক অথবা ফিরে আসার বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কানাডার আর্ল ডেনমেন হোক। সাধারণত এই পর্বতে আসা অভিযাত্রীদের থাকত বিশাল বহর। সাথে শতশত মালবাহক, বোতলজাত কৃত্রিম অক্সিজেন এবং ব্যাপক রসদ। ১৯৬০ সালে চূড়ায় মাও সেতুং এর মূর্তি রেখে আসা অভিযানের তিন পর্বতারোহীর জন্য ছিল ২০০ মালবাহক। ওই ধরনের সামরিক ঘরানার অভিযানের বিপরীতে এই চারজনের নিজেদের মালামাল বয়ে নুপলা পাড়ি দেওয়া, মাইলের পর মাইল হিমবাহ পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর শীর্ষ পর্বতের গোঁড়ায় পৌঁছানো এবং স্বনির্ভর আরোহণ পরিকল্পনা অবশ্যই এক দুঃসাহসী প্রয়াস। তখনকার বেশিরভাগ অভিজ্ঞ পর্বতারোহীর মতে যা ছিল ‘অসম্ভব’।

গেয়াশুং কাং থেকে এভারেস্টে যাত্রা পথে প্রায় সম্পূর্ণই চলতে হয় ১৮,০০০ ফুটের ওপর দিয়ে। ৪৮০ পাউন্ড রসদ গেয়াশুং কাং হাইক্যাম্পে নিয়ে আসে মালবাহকের দল। ৩০ দিন পর ওদের বেসক্যাম্পে আসতে বলে বিদায় দিলেন। এরপর যাত্রা করলেন পূর্ব দিকে। নুপলাতে উঠতে অনেক কষ্ট হলেও, নেমে যান সহজেই। তৃতীয় মানব হিসেবে এই সীমানা পাড়ি দিয়ে তিব্বতে প্রবেশের সাথেই স্যয়ার মনে হলো তিনি উপড়ে ফেলেছেন কাঁটাতারের এক বাধা।

৯ মে তাঁরা পশ্চিম রংবুক হিমবাহের প্রান্তে পৌঁছে গেলেন। এই স্থান খুঁজে বের করেন ১৯২১ সালে ম্যালরি এবং বুলক। শেষবার এখানে আসেন ১৯৫২ সালে হিলারি এবং লৌয়ে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডুটল বলেন, ‘যেন এক নিষিদ্ধ অঞ্চলে প্রবেশ করেছি। এ যেন আশা এবং স্বপ্নের ভূমি। ফিরে যেতে পারব? পরোয়া করিনি। এখানে আসাই ছিল আসল উদ্দেশ্য। বেঁচে থাকার সত্যিকারের কারণ।’

স্যয়ার পর্বতে চড়ে আবার নেমে আসতে বরাদ্দ করেছিলেন ২৩ দিন। কিন্তু রসদ সহ পর্বতের গোড়ায় পৌঁছাতে তাঁদের লেগে গেল ১৯ দিন। এই স্থান ডেনালি’র চেয়েও উঁচু। গভীর তুষার ঠেলে এগিয়ে যেতে সময় বেশ লেগেছে। বিলম্বের কারণ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্যয়ার সহাস্যে বলেন, ‘ডুটল এবং খাদের মধ্যে প্রাকৃতিক আকর্ষণ দেখে আমি হতবাক।’ পঞ্চাশ বছর পরও ডুটল অপরাধবোধে ভোগেন সঙ্গীদের গতি শ্লথ করার জন্য। ‘ক্লান্তি, ভয়ে আমি দলের অগ্রগতিতে বাধা হয়ে যাচ্ছিলাম’। আত্মসমালোচনা একটু বেশিই করেছেন ডুটল। কারণ দলের সবাই অবসন্নতা, পাকস্থলী সমস্যা এবং সর্দিকাশির মতো উচ্চতাজনিত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছিলেন।

১৯২০ এবং ১৯৩০ এর ব্রিটিশ ক্যাম্পের কাছে ১৯৬০ এর চীনা ক্যাম্পে পেলেন টিনজাত কাঁকড়ার মাংস এবং শিমের বিচি। নিজেদের শুকিয়ে নেয়া মাংসের টুকরা ছাড়া অন্য খাবার পেয়ে চারজনই বেশ খুশি। ম্যালরি, বুলক এবং হুইলার ১৯২১ সালে নর্থ কলে ১৫০০ ফুটের উলম্ব ঢাল অতিক্রম করেন। স্যয়ারের আশা ছিল এই খাড়া ঢাল একদিনেই পেরিয়ে যাবেন। কিন্তু একটি ফাটল তা হতে দিল না। সময় লাগল তিন দিন। অবশেষে ৩১ মে স্যয়ার স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি এসে গেলেন। ২৩,০০০ ফুট উপরে নর্থ কলের শীর্ষ থেকেই ফিরে এলেও তা এমন কীর্তি হতো যা অভিজ্ঞদের চোখও কপালে তুলে দিত। কিন্তু বিকেলে ডুবন্ত সূর্যের আলোয় ৬,০০০ ফুটের কম দূরত্বে এভারেস্টের শীর্ষবিন্দু দেখে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। স্যয়ার বিস্ময়ের সাথে অনুভব করলেন চূড়ার অলৌকিক স্বপ্ন তখন রূপ নিয়েছে সত্যিকারের সম্ভাবনায়।

আবহাওয়া শান্ত। এভারেস্টের পুরো দেয়ালই শুকনো। অভিযোজন নিয়েও কোনো সমস্যা নেই। সবকিছুই সম্ভাবনা জাগানিয়া। এমন সময় ঘটল এক দুর্ঘটনা। রসদ আনতে উল্লসিত স্যয়ার হার্টের সাথে সন্ধ্যায় সূর্য ডোবার পর নামছিলেন। ওই শীর্ষস্থান থেকে মাত্র ৬০ ফুট নিচে হার্টের পা পিছলে গেল। পতনের সময় দড়ি স্যয়ারকেও টেনে নিল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুজনই শুন্যে। মনে হলো এই বুঝি শেষ! এরপর আছড়ে পড়লেন এক তুষার স্তুপে। এযাত্রায় বেঁচে গেলেও স্যয়ারের একটা পাঁজর ভেঙে গেল। বাহুও বাজে রকমের থেঁতলে গেল। হার্ট তখন দিকভ্রান্ত। এই অবস্থায় বড় সমস্যা হলো ২২,০০০ ফুট উঁচুতে খোলা আকাশের নিচে ওই রাত বেঁচে থাকা। তাঁরা হামাগুড়ি দিয়ে এক ফাটলে ঢুকে পড়লেন। নিজেদের ক্ষতবিক্ষত শরীরকে সাথে থাকা সবকিছু দিয়ে ঢেকে নিলেন। এক দীর্ঘ, কষ্টকর রাত্রি শেষে আবার নিজেদের টেনে নিলেন ঢালের দিকে। তখনো মনে শীর্ষ আরোহণের দৃঢ় প্রত্যয়। আর যাই অভাব থাকুক না কেন, স্যয়ারের দলের মানসিক দৃঢ়তার কমতি ছিল না।

২ জুন। স্যয়ার এবং হ্যানসেন নর্থ কলের উপরে পৌঁছান। পরিকল্পনা ছিল হার্ট দিন দুয়েকের মাঝেই তাঁদের সাথে যোগ দিবেন। আর ডুটল ক্যাম্পে আরেক দফা রসদ নিয়ে যাবেন। পরের দুইদিন স্যয়ার এবং হ্যানসেন প্রচণ্ড তুষার এবং বাতাসের সাথে লড়াই করে রিজ লাইন ধরে এগিয়ে গেলেন। স্যয়ারের যেখানে আশা ছিল দিনে ২০০০ ফুট এগিয়ে চলার, সেখানে ৬০০ ফুট এগুনোই কষ্টসাধ্য ব্যাপারে পরিণত হলো।

স্যয়ার বুঝলেন এই গতিতে চললে শীর্ষে পৌঁছাতে আরও এক সপ্তাহ লেগে যাবে। অতদিন টিকে থাকার মতো রসদ বা শক্তি ওদের নেই। ঠিক করলেন শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক কতদূর এগুনো যায়। ক্যামেরা এবং অল্প খাবার নিয়ে এগিয়ে ১৯২৪ এর ব্রিটিশ তাঁবুর কাছাকাছি আনুমানিক ২৫,৪০০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছালেন। ঝড় তখনো পেয়ে বসেনি। এই দিনে ম্যালরির ২৬,৮০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প৬ থেকে যাত্রা করলে তা হতো সামিটের জন্য আদর্শ। কিন্তু শক্তি প্রায় নিঃশেষ। ক্ষুধা, তৃষ্ণায় কাতর স্যয়ার চূড়ার মাত্র ২,৫০০ ফুট নিচ থেকে ফেরার কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিলেন। নামার পথে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিলেন। হেঁটে নামার পরিবর্তে গড়িয়ে নামতে শুরু করেন। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। পাথরে আঘাত পেয়ে গড়াতে গড়াতে হাইক্যাম্পের একটু নিচে, প্রায় ৬০০ ফুট নিচে গিয়ে পতন থামল। মাথা এবং বাহু রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁবুতে আশ্রয় নিলেন।

এক সপ্তাহের কম সময়ে দুইটি প্রাণঘাতী পতনের অভিজ্ঞতা স্যয়ারকে জানিয়ে দিল তিনি ভাগ্যের বিরুদ্ধে লড়ছেন। ভাগ্যবান বলেই আঘাত মূলত মাংসপেশীর উপর দিয়ে গেছে, হাড়ে লাগেনি। দলে কোনো ডাক্তার নেই। সহযাত্রীরাও কেউই অভিজ্ঞ নন। তাই নর্থ কলের ওই খাড়া, উন্মুক্ত তুষারপ্রান্তর এবং বিশাল খাদে ভর্তি পথ দিয়ে কোন মারাত্মকভাবে আহত ব্যক্তিকে উদ্ধার প্রায় অসম্ভব। এমনকি যদি পূর্ব রংবুক হিমবাহে নামা সম্ভবও হয়, বাকি থেকে যাবে ২৫ মাইল দূরে তাঁদের বেসক্যাম্প।

(চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধইকবাল করিম হাসনুর কলকাতা ছুঁয়ে
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬