পর্ব–৩
দলের চার সদস্যই কমপক্ষে একবার মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছেন। ১৯২২ সালে নর্থ কলে তুষারধসে মারা যাওয়া ৭ শেরপা এবং দুইবছর পর হারিয়ে যাওয়া ম্যালরি এবং আরভিনসহ ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এভারেস্ট অভিযানে মৃতের সংখ্যা ছিল ১৭ জন। এই অভিযান নিতে পারত আরো চারটি প্রাণ, অজানাই থেকে যেত গেয়াশুং কাং অভিযানের পরিণতি। হার্ট লিখেন, ‘বেশ কিছু পরিস্থিতি এমন ছিল যেখানে আমরা মারা যেতে পারতাম। আমরা ছিলাম অনভিজ্ঞ। কিছু সাংঘাতিক ভুল এবং হিসেবের গরমিল করেছি। প্রস্তুতি ছিল অপর্যাপ্ত। কোনো সাহায্য থেকে ছিলাম অনেক দূরে। আমরা শত শত মিটার গড়িয়ে পড়েছি। দুর্ঘটনার রেকর্ড গড়েছি। এবং এখনো বেঁচে আছি।’
ফেরাটা ছিল আরেক মহাকাব্য। তাঁরা ক্লান্ত, ক্ষত–বিক্ষত এবং ক্ষুধার্ত। পাখিরা তাঁদের খাদ্য সরবরাহ লুন্ঠন করেছে। মালবাহকেরা তাঁদের মৃত ধরে নিয়ে বাকি রসদ নিয়ে ফিরে গেছে। ২১ জুন ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ স্যয়ার দলের নিখোঁজ হবার খবর ছাপায়। সবাই ধরে নেয় যে গেয়াশুং কাং পর্বতে তাঁরা হারিয়ে গেছেন। সংবাদ প্রকাশের দুই দিন আগে ক্ষুধার্ত অভিযাত্রীরা আশ্রয় নেন বেসক্যাম্পের নিচে এক চাষির ঘরে। একটা ভেড়া জবাই করে নিজেদের ক্ষুধা মেটান। ২৩ জুন তাঁদের জীবিত থাকার খবর পেয়ে আমেরিকান দূতাবাস তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হেলিকপ্টার পাঠায়। হেলিকপ্টারে ছিলেন নরম্যান ডাইরেনফোর্ট। ১৯৬৩ এর এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি নিতে তিনি নেপালেই ছিলেন। স্বদেশী অভিযাত্রীদের দুর্দশার খবর পেয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তিনিও জানতেন যে স্যয়ারের দল গেয়াশুং কাং অভিযানে হারিয়ে গিয়েছিল।
নরম্যান নিজেদের এভারেস্ট চূড়ায় দেখতে চেয়েছিলেন সাবধানতা অবলম্বন করে, নিয়মতান্ত্রিকভাবে। খুঁজে বের করেছেন ২০ জন সেরা পর্বতারোহীকে। তাঁর ইচ্ছা ছিল নেপালের সাউথ–ইস্ট রিজ ধরে আরোহণের। এরপর নতুন রুট সম্ভব হলে তা হবে বাড়তি প্রাপ্তি। তিনি অর্থ যোগাড় করেন, নিশ্চিত করেন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির আনুষ্ঠানিক এবং কেনেডি সরকারের অনানুষ্ঠানিক সমর্থন।
স্যয়ারের দল ওই ছয় সপ্তাহ কোথায় ছিল শুনে হতবুদ্ধি হয়ে যান নরম্যান। চীন এই অনুপ্রবেশের কথা জানলে নেপাল যুদ্ধভাবাপন্ন প্রতিবেশীকে শান্ত রাখতে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকার এভারেস্ট অভিযানই বাতিল করে দিতে পারে। ঝামেলা এড়াতে স্যয়ার নেপালে পুরোটা সময় জুড়ে গেয়াশুং কাং এর গল্প চালিয়ে যান। আমেরিকাতে ফিরে লাইফ ম্যাগাজিনে সত্য ঘটনা বিস্তারিত জানাতে উদ্যোগ নেন স্যয়ার। নরম্যান গোপনে তাঁর কাছে বার্তা পাঠান, ‘এই অভিযানের ব্যাপারে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। আশা করি এই গল্প কোথাও প্রকাশ হবে না।’ স্যয়ারকে দমাতে তিনি আমেরিকান আল্পাইন ক্লাবের প্রেসিডেন্ট চার্লটন ফুলারকেও চিঠি লিখেন। ফুলার উত্তরে জানান যে স্যয়ার ক্লাবের সদস্য নন। তাই এই ব্যাপারে কিছু করণীয় নেই।
এরপর নরম্যান আমেরিকান স্টেট্ ডিপার্টমেন্ট, সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, এমনকি প্রেসিডেন্ট কেনেডির সাথে পর্যন্ত যোগাযোগ করেন স্যয়ার কান্ডের প্রকাশনা থামাতে। তিনি আশঙ্কা করেন যে এতে ভবিষ্যতে হিমালয়ে অভিযান আমেরিকার জন্য সীমিত করা হতে পারে। বেশ কিছুদিন ধরে ছুতো খোঁজা চীনের কমিউনিস্টরা নেপাল দখলও করে নিতে পারে। নরম্যানের উদ্বেগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন ছিল না। যেমন ১৯৬৫ সালে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে চীনকে শান্ত রাখতে তিন বছরের জন্য নেপাল বিদেশীদের হিমালয় অভিযানে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
১৯৬৩ সালের মার্চে নরম্যানের দল কাঠমান্ডু পৌঁছায়। আর এদিকে লাইফ ম্যাগাজিনে ‘কমান্ডো রেইড অন এভারেস্ট’ নামক উত্তেজক শিরোনামে স্যয়ারের দলের গল্প ছাপা হয়। সৌভাগ্যবশত চীনারা এদিকে নজর দেয়নি। নরম্যানের দলের এভারেস্ট অভিযানও পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। জিম হুইটেকার এবং শেরপা গোম্বু ১ মে সাউথ–ইস্ট রিজ দিয়ে সামিটে পৌঁছান। ২১ দিন পর ওই দলের টম হর্নবাইন এবং উইলি আনসোয়েল্ড ওয়েস্ট রিজ দিয়ে প্রথমবারের মতো সামিট করেন।
এদিকে স্যয়ার ১৯৬৪ সালে নিজের গল্পকে বই–এ রূপ দেন ‘ফোর এগেইনস্ট এভারেস্ট’ শিরোনামে, যা প্রায় ২০,০০০ কপি বিক্রয় হয়। ১৯৬৩ সালের অভিযান নিয়ে লেখা জেমস রামসি উলম্যান এর ‘আমেরিকানস অন এভারেস্ট’ এবং হর্নবাইন এর ‘এভারেস্ট: দ্য ওয়েস্ট রিজ’ এর সাথে স্যয়ারের এই বই আমেরিকার তরুণদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করে। সামিটের কোন গর্বিত ছবি না থাকলেও এক দুর্র্ধষ অভিযানের গল্প, প্রথাবিরোধী ইশতেহার এই বইয়ের প্রতি পাঠকদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ। ওই দশকে যেসব আমেরিকান তরুণ পর্বতারোহী প্রচলিত মূল্যবোধ এবং নিয়মের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, এই বই তাঁদের কাছে হয়ে দাঁড়ায় অনুপ্রেরণার উৎস। ১৯৬৪ সালে বইয়ের রিভিউ করতে গিয়ে ‘দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস’ শিরোনামে লিখে ‘মাউন্ট এভারেস্টে স্যয়ারের অভিযান ছিল ক্ষ্যাপাটে, অপ্রস্তুত, কিন্তু প্রশংসনীয়’।
আমেরিকার পর্বতারোহণের ইতিহাসে ভবঘুরে ব্যক্তিত্বের খেয়ালি মনের এক প্রলেপ রেখে যান ওই চার পর্বতারোহী। তাই ওই যুগের বেশিরভাগ পর্বতারোহীর কাছেই স্যয়ারকে মেনে নেয়া ছিল কষ্টকর। স্যয়ারও কম নন। তিনি ১৯৬৩ সালের আমেরিকার এভারেস্ট অভিযানকে ‘আমেরিকার দ্বিতীয় এভারেস্ট অভিযান’ নামে আখ্যায়িত করতেন।
ব্রিটিশ কিংবদন্তী ডৌগ স্কট ১৯৯৯ সালে স্যয়ারের অভিযান সম্পর্কে বলেন, ‘অপরিপক্ক হলেও এই অভিযান পর্বতারোহণের ধরণ পাল্টাতে বিশেষ অবদান রেখেছে’। একদল বন্ধু কৃত্রিম অক্সিজেন, আগে থেকে লাগানো দড়ি এবং ক্যাম্প, শেরপা সাহায্য ছাড়াই এগিয়েছে নিজেদের স্বপ্নকে ছুঁতে। আরেক ব্রিটিশ কিংবদন্তি এরিক শিপটন স্যয়ারকে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘এত সামান্য রসদ নিয়ে ওই দীর্ঘ এবং দুরূহ পথে অতদূর পৌঁছা এক চমৎকার অর্জন’।
এখন পর্বতারোহণ সার্বজনীনতা লাভ করেছে। পুরোনো ক্লাবগুলো হারিয়েছে দ্বাররক্ষকের স্বীকৃতি। অভিযানে ছোট দলই হয়ে দাঁড়িয়েছে আদর্শ। তবুও এই যুগে বাণিজ্যিক অনুদান, উন্নত গিয়ার, যোগাযোগ মাধ্যমের উপর নির্ভরশীলতার সাথে স্যয়ারের সম্পূর্ণ দলছুট আত্মনির্ভরশীল উৎসাহের খুব কমই সাদৃশ্য আছে। ওই অভিযানে চার বলিষ্ঠ প্রাণ কী করছে না জেনেই নিজেদের স্বপ্ন সত্য করতে ভয়ংকর সুবিশাল বিচ্ছিন্ন পর্বতাঞ্চলে নিজেদের সঁপে দিয়েছিল। স্যয়ার লিখেছেন, ‘কালো প্রস্তরখন্ড, উজ্জ্বল বিশুদ্ধ নীলবর্ণ ছায়ারাশি, ফিনফিনে সাদা স্ফীত তুষার, নীলকান্তমণি নীল খাদ এবং বরফে সূর্য কিরণে হীরের ঝলককৃতমানুষ যেখানে গীর্জা দর্শনে সমুদ্র পাড়ি দিতে পারে, কেন একজন এমন দৃশ্য দর্শনে ততটুকু বা বেশি করতে পারবে না?’।