এভাবেই কি আরব বিশ্ব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শুক্রবার , ২৩ মে, ২০২৫ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

ইসমাঈল হানিয়া, মোহাম্মদ দেইফ, ইয়াহিয়া সিনাওয়ার, মোহাম্মদ সিনাওয়ারএরপর কে? হায় আল্লাহ! হামাস কি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে? বড় ভাইয়ের হাত ধরে যে সিনাওয়ার মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাসএ যুক্ত হয়েছিলেন সেই সিনাওয়ার পৃথিবীর সফর শেষ করেছেন সেদিন। বর্বর ইহুদিরা গাজার ধ্বংসস্তুপের মাঝে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলমান ইউরোপিয়ান হাসপাতালে ৯টি মিসাইল নিক্ষেপের মাধ্যমে আলকাস্‌সাম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ সিনাওয়ারকে শহীদ করেছে। চারদিন পর সিনাওয়ারসহ তাঁর সহযোগী মোট ১০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে গাজা কর্তৃপক্ষ। এভাবেই শেষ হল একটি সিনাওয়ার অধ্যায়। জানিনা, এরপরে হামাসের নেতৃত্বে কে আসবে? তবে আমরা আশাবাদী, আগের অকুতোভয় আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া সৈনিকদের আদর্শের পতাকাবাহী একজন ঈমানদার যোদ্ধা আসবেই। উনি হাল ধরবেন হামাসেরএ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তবে এবার তারা হামাস নেতার নাম ঘোষণা করবে কিনা জানিনা। হয়তো নাও করতে পারে কৌশলগত কারণে। বর্বর নেতানিয়াহুর বাহিনী এরই মধ্যে তেপ্পান্ন হাজার গাজাবাসীকে নির্মমভাবে শহীদ করেছে। তার মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। এক লক্ষ ত্রিশ হাজারের মতন আহত করেছে। বাস্তুচ্যূত হয়েছে বিশ লাখের কাছাকাছি। খান ইউনিস, জাবালিয়া, দেইর আল বালা সহ শরণার্থী শিবিরগুলো টার্গেট করে যৌথভাবে বিমান ও স্থলপথে আক্রমণ চালাচ্ছে কুখ্যাত ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীরা। আইডিএফ এরই মধ্যে ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনা মোতায়েন করেছে হামাস সহ পুরো গাজার নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য। আগে যেখানে ৩০৪০ জন নিরীহ গাজাবাসীকে তারা শহীদ করত, সেখানে গত ১ সপ্তাহ ধরে শতাধিক গাজাবাসীকে তারা শহীদ করছে। এক ভয়ংকর শর্তের মাধ্যমে ইসরায়েল হামাসের সাথে চুক্তি করতে চাচ্ছে। তা হল: সমস্ত জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে, হামাসকে অস্ত্র সমর্পণ করতে হবে এবং উপত্যকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমরা জানিনাহামাস এই চুক্তি মেনে নিবে কিনা। তবে গাজা দখলের যে ভয়ংকর নীল নকশা নেতানিয়াহু প্রশাসন বাস্তবায়ন করতে উঠে পড়ে লেগেছে তা এই শর্তের মধ্যেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে মজলুম মানুষদের যদি ধরা হয় তাহলে গাজাবাসীকে বলা হবেএতে কোন সন্দেহ নেই, কারণ গত ৬০ দিন ধরে কোন ত্রাণবাহী ট্রাক উপত্যকায় ঢুকতে দিচ্ছে না বর্বর ইসরায়েলিরা। অনাহারেঅর্ধাহারে প্রতিদিন পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে অসংখ্য ফিলিস্তিনি। আর এর মধ্যে শিশুদের সংখ্যাই বেশি। সুপেয় পানির কোন ব্যবস্থা নেই, স্যানিটেশনের কোন ব্যবস্থা নেই, অপরিষ্কার আবর্জনাযুক্ত পানি আর সীমিত আকারে ত্রাণ নিয়ে হয়ত কোনমতে বেঁচে আছে অসহায় মজলুম গাজাবাসী। আর এরই মধ্যে গত সপ্তাহে মুনাফেক আরব রাষ্ট্রগুলো মেতে উঠেছে বিনোদনের অসভ্য আড্ডায়। বিশ্ব সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আমেরিকার খ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বেগুনী গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর দেশে। ফেরাউনতুল্য মুনাফেক যুবরাজ সালমান এই ইহুদি রাষ্ট্র প্রধানের সাথে ২০০ বিলিয়নের অধিক ডলারের চুক্তি করেছে। তার মধ্যে আমেরিকার তৈরি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি হয়েছে অন্তত ১৬০টি। এই সংক্ষিপ্ত সফরে এই মুনাফেক যুবরাজ সালমান একটি বারের জন্যও গাজায় যে গণহত্যা চালাচ্ছে তার ঘনিষ্ঠ সহচর বর্বর নেতানিয়াহু, তা ঘূর্ণাক্ষরেও বলেনি। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, মুসলমান নামধারী আরব শাসকরা পশ্চিমাদের তোষামোদ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মুসলিমদের হৃদয়ে আশা জেগেছিল যে, এবার হয়তো বা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোষণা আসবে। সমস্ত আশাভরসাকে ধুলিসাৎ করে শয়তান যুবরাজ সালমান তার পুরানো কায়দার পথেই হেঁটেছে মাত্র। এরপরে কাতার গমন, কাতারের আমিরের সাথে সৌদির মতন ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছেযার মধ্যে আমেরিকান বোয়িং কোম্পানীর ২০০টির কাছাকাছি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি রয়েছে। আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে: ৪০০ মিলিয়ন ডলারের একটি উড়োজাহাজ উপহার দেওয়া হয়েছে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। অবশ্য কাতারের আমির গাজায় গণহত্যা বন্ধের জন্য সন্ত্রাসী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইঙ্গিত করে কিছু কথা বলেছেন। জবাবে মানসিক বিকারগ্রস্ত এই প্রেসিডেন্ট গাজার প্রসঙ্গটা না এনে ইরানের পরমাণু চুক্তি কর্মসূচীতে কাতারের অনবদ্য সহযোগিতা কামনা করেন। সেখানে কাতারের বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদ দেখে ট্রাম্পের মাথা খারাপ, চোখ ছানাবড়া। এরপরেই মধ্যপ্রাচ্যের আরেক মুনাফেক মুসলিম রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত গমন, সেখানেও তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনার পাশাপাশি আরব তরুণীদের খোলাচুলের নৃত্য প্রদর্শন করা হয়েছে, যা অত্যন্ত গর্হিত। গাজার শিশুরা যেখানে একটি শুকনো রুটির জন্য সারাদিন অপেক্ষা করেও সেই কাঙ্খিত রুটি পায় না, সেখানে ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে মেতে উঠেছে এই অসভ্য আরব শাসকরা। সারা বিশ্বে যেখানে ফিলিস্তিনের পক্ষে গণহত্যা বন্ধের জন্য মিছিলমিটিংসমাবেশমানববন্ধন হচ্ছে, সেখানে উপরোক্ত তিনটি আরব দেশে কোন সমাবেশ কিংবা মানববন্ধন, কিংবা প্রতিবাদ দেখেনি এই বিশ্ব। খোদ ইসরায়েলের ভেতর যেখানে নেতানিয়াহু বিরোধী স্লোগানে স্লোগানে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, সেখানে আরব শাসকরা বিলাসী জীবন যাপনে মেতে উঠেছে বারবার। পুরো গাজার সবুজ প্রান্তর আজ রক্তাক্ত। রক্তের দাগ এখনও যেন শুকায়নি। প্রতিটি রক্তবিন্দু থেকে উঠে আসছে বিদ্রোহের দাবানল। মুক্তিকামী স্বাধীনতা গোষ্ঠী হামাসের প্রতিটি সদস্যই নিজ মাতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ে নিজের জীবনকে বিসর্জন দিচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্তে। ২০০ কোটি ডলারের অফার ফেরত দেওয়া মোহাম্মদ সিনাওয়ারকে তারা নির্মম ভাবে শহীদ করেছে কিন্তু শত শত সিনাওয়ার আবার জেগে উঠবে মুক্ত বিহঙ্গের মতন, ফিনিক্স পাখির মতন। তারা ভেবেছিল হামাসকে নির্মূল করবে, জিম্মিদের ফিরিয়ে আনবে কিন্তু এই কাপুরুষ ইহুদিরা বারবার নিরীহ গাজার মানুষদের পাঠার বলি করছে। দেড় বছরে তারা কোন লক্ষ্যই অর্জন করতে পারেনি শুধুমাত্র নিরীহ মানুষ হত্যা ছাড়া। আজ মুসলিম বিশ্ব চুপ, আরবলীগ চুপ, ওআইসি চুপমাঝে মাঝে জাতিসংঘের নড়াচড়া দেখা যায়। আমাদের বাংলার দামাল ছেলেরাও স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত করেছিল রাজধানী। আর শেষ রাতের আঁধারে চোখের জলে ভাসিয়েছে পুরো বিশ্ব। সেই কান্নার আওয়াজ আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। যেখানে দেড় হাজার শহীদের বিনিময়ে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেখানে তেপ্পান্ন হাজার শহীদের বদলে এখনো আসেনি গাজায় শান্তির সুবাতাস, বন্ধ হয়নি গণহত্যা, বন্ধ হয়নি রক্তপাত। গাজার আকাশে বারুদের গন্ধ, রক্ত নিয়ে খেলছে বর্বর ইহুদিরা।

আমার আল্লাহতায়ালার আরশ কি কেঁপে উঠে না? অবশ্যই উঠে কিন্তু তিনি তো উত্তম পরিকল্পনাকারী। হয়তো এখানে রয়েছে তাঁর অসীম কুদরতি শক্তি। হয়তোবা আল্লাহতায়ালা ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন গাজাবাসীদের। ভয়ংকর দাবানল দমাতে পারেনি বর্বর ইসরায়েল বাহিনীকে। জিম্মিদের স্বজনদের বিক্ষোভ দমাতে পারেনি একটুও ইতিহাসের হিটলারখ্যাত নেতানিয়াহুকে। কখন আসবে আল্লাহর সাহায্য? আর আল্লাহতায়ালা ১৪০০ বছর আগেই সেই কথাটি বিধৃত করেছেন এভাবেই, ‘তোমরা কি মনে করে নিয়েছো যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের বিপদের মতন কিছুই তোমাদের কাছে এখনো আসেনি, তাদের উপর অভাব অভিযোগ ও রোগব্যাধি এসেছে, কঠিন নিপীড়নে তাদের প্রকম্পিত করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি স্বয়ং নবী ও তাঁর সঙ্গী সাথীরা এই বলে আর্তনাদ করে উঠেছে, আল্লাহতায়ালার সাহায্য কবে আসবে? আল্লাহতায়ালা শান্তনা দিয়ে বললেন, হাঁ আল্লাহতায়ালার সাহায্য অতি নিকটে’সূরা বাকারা২১৪। আমাদের কষ্ট লাগে যেখানে অমুসলিম রাষ্ট্র স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ ইসরায়েলকে গণহত্যাকারী রাষ্ট্র হিসাবে অভিহিত করেছেন, সেখানে মুনাফেক আরবরাষ্ট্রগুলো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। বর্বর নেতানিয়াহু যে গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে সেটা বলতেও ভয় পাচ্ছে, কিসের ভয়? অবশ্যই আমেরিকাকে তারা যমের মতন ভয় করে। আমি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলতে চাই, আরব নেতারা মুসলিম নামধারী হলেও এদের মাঝে সরিষার দানার মতনও ঈমান নেই। ঘুমিয়ে থাকুন মুসলিম বিশ্ব, ঘুমিয়ে থাকুন আরব বিশ্ব, আমরা নামধারী মুসলিমরাও ঘুমিয়ে আছি।

লেখক: সভাপতিরাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌতুকের কারণে পরিবার ভাঙে : প্রতিরোধ গড়ে তোলা আবশ্যক
পরবর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর