২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই ঘষামাজা করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মূল্যায়নকৃত পৌরকর (গৃহকর ও অন্যান্য রেইট) থেকে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়ার আরো একটি অনিয়ম উন্মোচিত হয়েছে। এবার পুরনো পদ্ধতিতে এ জালিয়াতি হয়েছে ইনকনট্রেড লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন নির্ধারণী অ্যাসেসমেন্টে। প্রতিষ্ঠানটির হোল্ডিংয়ের বিপরীতে চসিকের সংশ্লিষ্ট অ্যাসেসর (পৌরকর মূল্যায়নকারী) ২৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা পৌরকর নির্ধারণ করেন। কিন্তু আপিল রিভিউ বোর্ডে উপস্থাপন করা হয় ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা। এক্ষেত্রে ‘ফিল্ডবুক’ এবং ‘পি ফরম’ (কর নির্ধারণ ও মূল্যায়নের বিরুদ্ধে আবেদন ফরম) থেকে ‘২’ মুছে দেয়া হয়। এতে কমে যায় ২০ কোটি টাকা। পরে রিভিউ বোর্ড তা মাত্র ৫৮ লাখ টাকায় চূড়ান্ত মূল্যায়ন করে।
ঘষামাজার মাধ্যমে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে চসিককে বিপুল অংকের রাজস্ব বঞ্চিত করার ঘটনায় জড়িত সংস্থাটির কর কর্মকর্তা নুরুল আলম এবং উপ–কর কর্মকর্তা আবদুল কাদের (অবসরপ্রাপ্ত)। তাদের সহায়তা করেছেন রাজস্ব সার্কেলের সহকারী মঞ্জুর মোরশেদ ও হিসাব সহকারী রূপসী রাণী দে। এতে ‘যোগসাজশ’ রয়েছে হোল্ডিং মালিকেরও। ইনকনট্রেড লিমিটেডের মালিকের নাম ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন।
বার্ষিক মূল্যায়ন পরিবর্তন করার ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে গঠিত চসিকের একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব অনিয়ম ও জালিয়াতির তথ্য উঠে আসে। গতকাল সন্ধ্যায় মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করা হয়। এর আগের দিন সোমবার সন্ধ্যায় হস্তান্তর করা অপর একটি তদন্ত প্রতিবেদনেও একই পদ্ধতিতে ইছহাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে অপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নকৃত পৌরকর থেকে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে দেয়ার সত্যতা মিলে। ইছহাক ব্রাদার্সের হোল্ডিংয়ের বিপরীতে নির্ধারণ করা ২৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা পৌরকর থেকে দুই মুছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ১৯ হাজার ২৫০ টাকা করা হয়। এ ঘটনা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হওয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই ইনকনট্রেড লিমিটেডের পৌরকর মূল্যায়নে অনিয়মের বিষয়টি উন্মোচন করে চসিকের তদন্ত কমিটি।
মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, পৌরকর নির্ধারণে এত বড় অনিয়ম দেখে আমি রীতিমত বিস্মিত। সাবেক মেয়র ও প্রশাসকের মেয়াদকালে এই অনিয়ম হয়েছে, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। ঘটনায় যারা জড়িত তাদের ক্লোজড করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। কর্পোরেশনে কোনো অনিয়ম ও দুর্নীতিকে আমি প্রশ্রয় দেব না।
চসিকের সচিব মো. আশরাফুল আমিন আজাদীকে বলেন, গুরু দণ্ড হলে বরখাস্ত করা যায়। এক্ষেত্রে কী করা যায় সে বিষয়ে আইন কর্মকর্তার মতামত নেয়া হচ্ছে। মেয়র মহোদয়ের নির্দেশে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
ধামাচাপা পড়েছিল ৫ বছর : পৌরকর নির্ধারণে ইনকনট্রেড লিমিটেডের হোল্ডিংয়ের বিপরীতে অ্যাসেসমেন্ট করা হয় ২০১৭–২০১৮ অর্থবছরে। তখন চসিকের মেয়র ছিলেন আ জ ম নাছির উদ্দীন। ঘষামাজা করে অনিয়মটি হয়েছে সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের মেয়াদকালে। তিনি রিভিউ বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন। রিভিউ বোর্ডে শুনানি হয়েছে ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর। পরে ২০২৩ সালে অনিয়মটি চিহ্নিত করে এক কর কর্মকর্তা প্রধান কার্যালয়ে (নগর ভবন) প্রেরণ করে। তখন মেয়রের দায়িত্ব পালন করা রেজাউল করিম চৌধুরী এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি। সর্বশেষ শাহাদাত হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর ঘষামাজা করে প্রকৃত বার্ষিক মূল্যায়ন পরিবর্তনে জড়িত অপরাধী শনাক্ত করার জন্য নির্দেশনা দেন। এর প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি জড়িতদের চিহ্নিত করে। প্রায় ৫ বছর ধামাচাপা পড়ে থাকা বিষয়টি গতকাল উন্মোচিত হলো।
চসিক সূত্রে জানা যায়, ১৩ জানুয়ারি ৪ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। ৩১ জানুয়ারি আকার বৃদ্ধি করে পাঁচ সদস্যে উন্নীত করা হয়। চসিকের আইন কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মুরাদকে আহ্বায়ক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে সদস্য সচিব করে গঠিত এ তদন্ত কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চৈতী সর্ববিদ্যা, শিক্ষা কর্মকর্তা রাশেদা আক্তার ও ৮ নং রাজস্ব সার্কেলের কর কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ।
যেভাবে অনিয়ম হয় : ইনকনট্রেড লিমিটেডের হোল্ডিং রয়েছে চসিকের ৮ নং রাজস্ব সার্কেলভুক্ত দক্ষিণ পতেঙ্গা ও দক্ষিণ–মধ্যম হালিশহরে। এর মধ্যে দক্ষিণ পতেঙ্গা মহল্লার ফিল্ড বই ২–এর ১০০ পৃষ্ঠায় হোল্ডিং নং ৫১৫/এ/৫৯৪ এর প্রকৃত বার্ষিক মূল্যায়ন সাদা ফ্লুইড ব্যবহার এবং ঘষামাজা করে পরিবর্তন করা হয়। অ্যাসেসর সমীর দত্ত বার্ষিক মূল্যায়ন করেন ২৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা; যা পাবলিশড কপিতে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট হোল্ডিংয়ের অ্যাসেসমেন্ট লিস্টে (কর নিরুপণ তালিকা) একই হোল্ডিংয়ের বিপরীতে বার্ষিক মূল্যায়ন ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা লেখা হয়। একই অংক লেখা হয় ট্যাঙ পেয়ার লেজারের সংশোধিত মূল্যায়নে। সেখানে চূড়ান্ত মূল্যায়ন দেখানো হয় ৫৮ লাখ টাকা।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, আবেদনকারীগণ সঠিকভাবে ২৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা মূল্যায়ন লিপিবদ্ধ করেন। পরবর্তীতে দোষী কর্মকর্তা–কর্মচারীদের যোগসাজশে ফিল্ডবুক ও পি ফরম ঘষামাজা করে মূল্যায়ন কমানো হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্যাক্স পেয়ার লেজার এবং কর নিরুপণ তালিকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সংশোধিত মূল্যায়ন তথ্যের তারিখ রয়েছে ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর। আবার একই তারিখে ইনকনট্রেড লিমিটেডের রিভিউ বোর্ডের শুনানি হয়েছে। অর্থাৎ রিভিউ বোর্ডের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেই ট্যাঙ পেয়ার লেজার এবং কর নিরুপণ তালিকা হালনাগাদ করা হয়।
এদিকে একই হোল্ডিংয়ের পি ফরমে ঘষামাজা করে ২৫ কোটি টাকার সর্ব বামের ২ অংকটি মুছে দিয়ে ৫ কোটি টাকা করা হয়। নিয়ম হচ্ছে, রিভিউ বোর্ডে আপিল শুনানির পূর্বেই পি ফরমে প্রদত্ত তথ্যের সঠিকতার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব সার্কেল কর্তৃক সার্টিফিকেট প্রদান করা। কিন্তু এখানে কোনো সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়নি।
কমিটির সিদ্ধান্ত : তদন্ত কমিটি পুরো ঘটনার বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তগুলো তুলে ধরে। এতে বলা হয়, ইনকনট্রেড লিমিটেডের ২০১৭–২০১৮ অর্থবছরের বার্ষিক মূল্যায়নে ফিল্ডবুকে ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে ৫ কোটি ৬৭ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা দেখিয়ে আপিল রিভিউ বোর্ডে উপস্থাপনের ঘটনায় কর কর্মকর্তা নুরুল আলম এবং উপ–কর কর্মকর্তা আবদুল কাদের জড়িত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হিসাব সহকারী মঞ্জুর মোরশেদ ও রূপসী রাণী দে তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেননি। তারা কর কর্মকর্তা ও উপ–কর কর্মকর্তার কথামতো কাজ করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন দাবি করলেও তথ্য গোপনের চেষ্টা করেন। এতে তারা ফিল্ডবুক ও পি ফরম ঘষামাজা করে মূল্যায়ন কমানোর অপরাধে কর কর্মকর্তা এবং উপ–কর কর্মকর্তাকে সহায়তা করেছেন মর্মে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়।
পুরো ঘটনায় হোল্ডিং মালিকের যোগসাজশ রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, সমগ্র ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পাশাপাশি হোল্ডিং মালিকও জড়িত। কারণ তারা এই অপরাধের বেনিফিশিয়ারি (সুবিধাভোগী)। তাদের কারণে চসিক বিপুল রাজস্ব বঞ্চিত হয়ে আসছে। এছাড়া পূর্বের বোর্ডের সিদ্বান্ত বাতিল করে প্রকৃত মূল্যয়নের ওপর ভিত্তি করে আপিল রিভিউ বোর্ডে শুনানি করা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
জড়িতদের জবানবন্দি : এ জালিয়াতির ঘটনায় জড়িতদের জবানবন্দি নিয়েছে তদন্ত কমিটি। এতে নুরুল আলম দাবি করেন, রিভিউ বোর্ড চলাকালে তার বড় ভাবীর মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি অফিস থেকে নিজ গ্রামে চলে যান। তার দাবি, আপিল ফরমে যাচাই বাছাই করার দায়িত্ব মহল্লা হিসাব সহকারী এবং উপ–কর কর্মকর্তার। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি তাদের পর্যালোচনায় উল্লেখ করে, গ্রামে যাওয়ার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি নুরুল আলম। তাছাড়া উপ–কর কর্মকর্তা আবদুল কাদের আপিল ফরমটি নুরুল আলমের কাছে উপস্থাপন করেছেন বলে দাবি করেন। তদন্ত কমিটি মনে করে, নুরুল আলম দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা করলেও আপিল ফরম যাচাই–বাছাই করার দায়িত্ব মহল্লা হিসাব সহকারী, উপ–কর কর্মকর্তা এবং কর কর্মকর্তার। রিভিউ বোর্ডে হিসাব সহকারী না থাকলেও উপ–কর কর্মকর্তা এবং কর কর্মকর্তা আবশ্যিকভাবে উপস্থিত থাকেন। তাই তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।
আবদুল কাদেরও তার বক্তব্যে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, তিনি চতুরতার সাথে পি ফরমে দেয়া তার স্বাক্ষর অস্বীকার করছেন। তবে কমিটি বিভিন্ন কপি পর্যালোচনা করে নিশ্চিত হয় স্বাক্ষরটি তার। আবদুল কাদের ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য গোপন করেছেন এবং মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। উপ–কর কর্মকর্তার কার্য পরিধি, দায় এড়ানোর প্রবণতা এবং স্বাক্ষর অস্বীকার করার বিষয়টি বিবেচনায় প্রতীয়মান হয়, পি ফরম এবং ফিল্ডবুকে ঘষামজা বা কাটাছেঁড়া করার ঘটনায় সরাসরি জড়িত।
একইভাবে মঞ্জুর মোর্শেদ প্রথমে পি ফরমে দেয়া তার স্বাক্ষর অস্বীকার করেন। পরে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন। তদন্ত কমিটি মনে করে, নিজের স্বাক্ষর প্রথমে অস্বীকার করা, তথ্য গোপনের চেষ্টা, ফিল্ড বুক ও পি ফরমে ঘষামাজা দেখেও কাউকে না জানানো এবং জবানবন্দিকালে একেকদিন একেক রকম বক্তব্য দেয়ায় তিনিও ঘটনায় জড়িত বলে প্রতীয়মান হয়।
জবানবন্দিতে রূপসী রানী দে প্রথমে ঘষামাজার টিও, ডিটিও বা অন্য কাউকে জানিয়েছেন কিনা মনে নেই বলে দাবি করেন। পরে আবদুল কাদেরকে দেখিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। তখন কাদের তাকে বলেছেন ‘ফিল্ডবুকে যা আছে তা লিখতে’।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইনকনট্রেড লিমিটেডের মতো এত বিশাল একটি স্থাপনার বার্ষিক মূল্যায়ন ফিল্ডবুক ও পি ফরমে ঘষামাজা করে ২০ কোটি টাকা কমিয়ে রিভিউ বোর্ডে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে কর কর্মকর্তা এবং উপ–কর কর্মকর্তা দায় এড়াতে পারেন না। এত উচ্চ মূল্যের একটি হোল্ডিংয়ের বার্ষিক মূল্যায়ন ২০ কোটি টাকা অবমূল্যায়ন করার বিষয়টি কর কর্মকর্তার না জানার দাবি বিশ্বাসযোগ্য নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ফিল্ডবুকে ঘষামাজা করার বিষয়টি একটি ষড়যন্ত্রমূলক কাজ, যা কর্পোরেশনকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। জড়িতরা নিজেরা অনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে এ কাজ সংঘটিত করেছেন। এ ধরনের ষড়যন্ত্র অতি গোপনে করা হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া সম্ভব নয়। শুধুমাত্র জড়িত ব্যক্তিরা এ বিষয়ে অবগত থাকেন। যে কারণে ঘটনা সংঘটনের সময় পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সংশ্লিষ্ট সার্কেলে কর্মরত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের কার্যপরিধি বা দাপ্তরিক দায়িত্ব এবং তাদের লিখিত বক্তব্য ও মৌখিক জবানবন্দি বিবেচনায় তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়।