প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে একের পর এক মৃত মা মাছ ভেসে উঠছে। গতকাল আবারও একটি মৃত কাতলা মাছ ভেসে উঠেছে। রাউজানের আজিমের ঘাট বাঁকে গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ১৯ কেজি ৩শ গ্রাম ওজনের মাছটি জোয়ারের পানিতে ভেসে আসে। মাছটির দৈর্ঘ্য ১শ ১৮ সেন্টিমিটার। ২২ জুন থেকে গত আট দিনে এই নদীতে মরে ভেসে ওঠা মা মাছের এখন সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচে। এই সময়ে মরেছে একটি ডলফিনও।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শ্রীবাস চন্দ্র চন্দ আজাদীকে বলেন, হালদায় মাছ মরার কারণ অনুসন্ধানে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি অনুসন্ধান চালিয়ে কারণ উদঘাটন করে রিপোর্ট দেবে। একই সাথে আজিমের ঘাটে সর্বশেষ পাওয়া মরা মাছ সংগ্রহ করা ভিসেরা পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হবে।
তিনি জানান, অনুসন্ধান কমিটিতে হালদাপাড়ের তিন উপজেলা হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তারা আছেন। এছাড়া হালদা প্রকল্পের একজন সহকারী পরিচালক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন আছেন। কমিটির প্রধান করা হয়েছে হাটহাজারী উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফারুক ময়েদুজ্জামানকে।
এ নিয়ে কথা বলতে হাটহাজারীর মৎস্য কর্মকর্তাকে ফোন করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে ফটিকছড়ি ও রাউজানের মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম ও আবদুল্লাহ আল মামুন (মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা) জানান, কমিটি বিষয়ে তারা জানেন না।
গতকাল মৃত মাছটি উদ্ধারকারী হালদা পাড়ের মৎস্যজীবী রোশাঙ্গীর আলম জানান, মাছটি নদী থেকে উপরে উঠিয়ে তিনি স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন আরিফকে জানান। চেয়ারম্যান ঘটনা শুনে উপজেলা প্রশাসনকে জানান। সংবাদ পেয়ে রাউজান থেকে মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন এসে মাছটি দেখেন। পরে ওই মৎস্য কর্মকর্তাসহ চেয়ারম্যান মাছটি উপজেলায় নিয়ে যান।
সর্বশেষ মাছটি আজিমের ঘাটে এনে মৎস্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন ময়নাতদন্ত রিপোর্ট করেন। এরপর উদ্ধারকারী মৎস্যজীবীর হেফাজতে দিয়ে যান। তাকে জানানো হয়, জেলা মৎস্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি দল আসছেন হালদাপাড়ে। তারা এসে দেখে মাছটি ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। সন্ধ্যা সোয়া ৭টা পর্যন্ত মাছটি হালদা নদীর পাড়ে ছিল। তখনো পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তা আসেননি।
একের পর এক মাছের মৃত্যু নিয়ে হালদাপাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, নদীতে প্রতিদিন পড়ছে শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যসহ নানা ধরনের দূষিত পদার্থ। তার ওপর নদীর সাথে সংযুক্ত খালে স্লুইসগেট খোলা–বাঁধার সুযোগ নিয়ে কিছু লোক খালের মাছ মারতে বিষ প্রয়োগ করে। সেই বিষ নদীর পানিতে মিশে যায়। এতে করে জলজ প্রাণী বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে বলে তাদের ধারণা।
উল্লেখ্য, গত বছর মুজিব বর্ষে হালদা নদীকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমন ঘোষণার পর নদীপাড়ের মানুষের ধারণা ছিল, এই নদীর জীববৈচিত্র্য ধরে রাখতে সরকারিভাবে পরিকল্পনা থাকবে। এসবের মধ্যে গত আট দিনে ৫ মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যু হালদাপাড়ের মানুষকে ভাবাচ্ছে। মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যুতে উৎকণ্ঠিত হালদা বিশেষজ্ঞরাও।
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ২৮ জুন হালদা নদীর উত্তর মাদার্শার কুমারখালী ঘাটে একটি মৃত কাতলা মা মাছ ও এর কিছুটা সামনে সুলতানা বাপের ঘাটে আরেকটি মৃত কাতলা মা মাছ ভেসে ওঠে। এক সপ্তাহে হালদা নদী থেকে ৫টি মৃত মা মাছ ও একটি মৃত ডলফিন উদ্ধার করা হয়েছে, যা হালদা নদীর জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। হালদায় বর্তমানে মনুষ্যসৃষ্ঠ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেমন শাখা খালের মাধ্যমে সরাসরি ফেলা হচ্ছে ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য ও অন্যান্য শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য, পোল্ট্রি বর্জ্য, গৃহস্থালী ও মানববর্জ্য। হালদা ও শাখা খালে অবৈধভাবে জাল, বড়শি ও বিষ ব্যবহার করে মাছ নিধন, অবৈধ বালু উত্তোলন বেড়ে চলেছে। এর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হালদা জলজ বাস্তুতন্ত্রে। এ অবস্থায় হালদা নদীতে মা মাছ, ডলফিন ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিডিনিউজ জানায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্য বিভাগের চেয়ারম্যান ও হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে এতগুলো মা মাছ ও ডলফিনের মৃত্যু হালদার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য একটি অশনিসংকেত। বেশ কয়েক মাস ধরে হালদার শাখা খালগুলোর দূষণের বিষয়টি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে। মা মাছের মৃত্যুর কারণ হিসেবে শাখা খালের দূষণ ও বিষ দিয়ে মাছ মারার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া–এ দুটোই প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে। হালদা নদীর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রক্ষায় মন্ত্রণালয়ের দ্রুত উদ্যোগ দাবি করেন তিনি।