এবার বন বিভাগের দাবি দাওয়া নিয়ে জটিলতা

চট্টগ্রাম বে-টার্মিনাল

হাসান আকবর | শুক্রবার , ৩১ মার্চ, ২০২৩ at ৪:৪৫ পূর্বাহ্ণ

মামলা মোকদ্দমার সুরাহা না হওয়ার পাশাপাশি এবার বন বিভাগের দাবিদাওয়া নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় থমকে আছে চট্টগ্রাম বেটার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প। ভূমি অধিগ্রহণ, ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ এবং অপারেটর নিয়োগসহ নানা বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে। এতে করে আগামী একশ বছরের দেশের চাহিদা মেটানোর কথা বলা হলেও এই বন্দর কবে নাগাদ চালু হবে তা নিয়ে সংশয় ব্যক্ত করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, হালিশহর সমুদ্র উপকূলে জেগে উঠা একটি চরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট প্রাকৃতিক একটি চ্যানেলে বে টার্মিনাল নামের বন্দরটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়। তিনটি টার্মিনাল নির্মাণ করে এই বন্দরের মাধ্যমে দেশের আগামী দিনের আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের সব চাহিদা মেটানোর কথাও বলা হয়। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত মেগা প্রকল্প বে টার্মিনাল। কিন্তু অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত প্রকল্পটি অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। প্রকল্পের জায়গা অধিগ্রহণ এবং হস্তান্তর না হওয়া মূলত প্রকল্পের অন্যান্য কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। শুরুতে ৯৩৯ একর ভূমিতে টার্মিনালসহ পশ্চাদসুবিধা নির্মাণের মাধ্যমে বে টার্মিনালের কার্যক্রম হওয়ার কথা। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ এতদিনে উক্ত ভূমির মাত্র ৬৮ একর হাতে পেয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন উক্ত ৬৮ একর ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষ কিনে নিয়েছে। ৬৮ একর ভূমিতে বালি ভরাটসহ উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা ছাড়া বে টার্মিনালের দৃশ্যমান আর কোনো অগ্রগতি নেই। এর বাইরে সরকারের ৮৭১ একর খাস জায়গা বে টার্মিনালের জন্য বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও জায়গাটি এখনো বন্দরের হাতে আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে উক্ত খাস জায়গা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তরের ব্যবস্থা করতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিলেও নানা আনুষ্ঠানিকতায় সবকিছু ঝুলে রয়েছে।

এদিকে এই ভূমির মধ্যে কিছু ভূমির মালিকানা দাবি করে বিভিন্ন ব্যক্তি আদালতে মামলা করেছে। এতে করে ভূমি হস্তান্তর দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যেসব ভূমির ব্যাপারে মামলা করা হয়েছে সেগুলো বাদ দিয়ে বাদবাকি ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া হলে কার্যক্রম এগুতে থাকতো। কিন্তু সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। একই সাথে বনবিভাগ থেকেও উক্ত জায়গাটিতে বনায়নের কথা রয়েছে বলে পৃথক একটি আপত্তি উত্থাপন করেছে। বন বিভাগের দাবি এবং মামলার বিষয়টি সুরাহা হওয়ার পরই জেলা প্রশাসন ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করতে পারবে। কিন্তু কবে এই মামলার সুরাহা বা দাবি থেকে বন বিভাগ সরে আসবে তা নিয়েও নিশ্চিত নন কেউ। জেলা প্রশাসন থেকে মামলার বাইরে থাকা খাস জায়গাগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও তাও দৃশ্যমান নয়।

বে টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে কোরিয়ার কুনওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনসালটিং কোম্পানি লিমিটেড এবং ডিয়েনইয়াং ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড যৌথভাবে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মোট ১২৬ কোটি ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ৯৮৬ টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠানটি বে টার্মিনালের ডিজাইন ড্রয়িং থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। কিন্তু জায়গার সুরাহা না হওয়ায় কার্যত সব আয়োজনই থেমে রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, বিষয়টি কিছুটা জটিল। আমরা জায়গার দখল না পেলে কাজ করবো কিভাবে? জায়গা নিয়ে কেউ কেউ মামলা করেছে। এখন আমরা মামলার বাইরের জায়গাগুলো হলেও হস্তান্তর করার অনুরোধ জানিয়েছি। দেখা যাক কি হয়।

বন বিভাগের দাবি একেবার অনর্থক ঝামেলা বলে মন্তব্য করে বন্দরের এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে কোনো বন নেই, কোনোকালে কোনো বন ছিলও না। সুতরাং বে টার্মিনালের সাথে বনায়নের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বন্দর নির্মাণ সম্পন্ন হলে এলাকার উন্নয়ন এবং গাছগাছালি লাগানো হবে।

অপর একটি সূত্র বলেছে, বে টার্মিনাল নির্মাণ করতে হলে সাগর শাসন করতে হবে, নির্মাণ করতে হবে ব্রেক ওয়াটার। কিন্তু দেশে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতা কারো নেই। কোনো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজটি করাতে হবে। প্রায় চার হাজার কোটি টাকা এতে খরচ হবে। ব্রেক ওয়াটার নির্মাণের জন্য অর্থের সংস্থানসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বেশ সময়ের প্রয়োজন। একেবারে মাঠ পর্যায়ের কাজ শুরু করলেও এমন একটি ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করে সাগর বশ করতে কমপক্ষে দুই বছর সময়ের প্রয়োজন। অপরদিকে জায়গার সংস্থান হওয়ার পর ইয়ার্ড নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজ করতে লাগবে অন্তত ৮ বছর সময়। কাজ শুরু না হওয়ায় এই ৮ বছর কবে গিয়ে শেষ হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেছেন, হতাশ হওয়ার মতো কিছু নেই। বে টার্মিনাল নির্মাণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। বৈশ্বিক সংকটসহ নানা কারণে আমরা কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বে টার্মিনাল প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার দেয়া একটি তালিকা। এটি নিয়ে অনিশ্চয়তার কিছু নেই।

উল্লেখ্য, বে টার্মিনাল বিদ্যমান চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে পাঁচগুণেরও বেশি বড় এলাকায় পরিচালিত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বার্থিং নিতে পারে। বে টার্মিনালে ১৪ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে। বে টার্মিনালে মোট তিনটি টার্মিনাল থাকবে। প্রতিটি টার্মিনালে ৩০০ মিটার লম্বা ছয়টি জেটি থাকবে। অর্থাৎ একটি টার্মিনালে ১৮শ মিটার লম্বা জেটি এবং পশ্চাদসুবিধা গড়ে তোলা হবে। প্রতিটি টার্মিনালে ছয়টি করে বে টার্মিনালে একই সাথে মোট ১৮টি বড় জাহাজ বার্থিং দেয়া যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহজ নিবন্ধনের সময় আবার বাড়ল
পরবর্তী নিবন্ধশিশুর নামে অসত্য লিখে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা কি অপরাধ নয়