এবার এলপি গ্যাসবাহী দুটি জাহাজে বিস্ফোরণ, আগুন

১১ ঘন্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে, ৩১ নাবিকের উদ্ধার পুড়ল সাড়ে ২২ কোটি টাকার গ্যাস, তদন্ত কমিটি

হাসান আকবর | সোমবার , ১৪ অক্টোবর, ২০২৪ at ৭:১০ পূর্বাহ্ণ

কুতুবদিয়ার অদূরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এলপি গ্যাসবাহী দেশিবিদেশি দুটি জাহাজে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের জলসীমায় জ্বালানিবাহী চারটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে দেখা হচ্ছে না। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ দুটির ৩১ জন নাবিককে উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনার প্রায় ১১ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকার এলপি গ্যাস পুড়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জ্বালানিবাহী জাহাজে একের পর এক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রাম বন্দরের ইমেজ ঝুঁকির মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে শিপিং সংশ্লিষ্টরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে তদন্ত করার নির্দেশনা প্রদান করেছে। নৌপরিবহন উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ঘটনা তদন্তে ৯ সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানিয়েছে, ওমান থেকে বসুন্ধরা এলপিজিসহ কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ৪২ হাজার ৯৭৫ টন এলপি গ্যাস নিয়ে ভিএলজিসি ক্যাপ্টেন নিকোলাস নামে একটি মাদার ভ্যাসেল গত ৬ অক্টোবর কুতুবদিয়ার অদূরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থান নেয়। গত শনিবার রাতে বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ৩ হাজার টন গ্যাস ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এলপিজি সোফিয়া নামের জাহাজে গ্যাস লাইটারিং করা হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন নিকোলাস জাহাজের মোটা রশি দিয়ে এলপিজি সোফিয়াকে বেঁধে গ্যাস লাইটারিং কার্যক্রম চালানো হচ্ছিল। রাত ১২টা ৪২ মিনিটে লাইটারিং অপারেশন শেষে এলপিজি সোফিয়াকে মাদার ভ্যাসেল ক্যাপ্টেন নিকোলাসের সাথে বাঁধা রশি খুলে আলাদা করার সময় প্রথমে ক্যাপ্টেন নিকোলাসের কার্গো পাইপলাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় বাতাসে দাহ্য গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রায় সাথে সাথে এলপিজি সোফিয়াতেও আগুন লাগে। মুহূর্তেই আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। আগুন জ্বলতে দেখে বিস্ফোরণের আশঙ্কায় এলপিজি সোফিয়ার ক্যাপ্টেন নূর মোহাম্মদসহ সব নাবিক এবং ক্যাপ্টেন নিকোলাসে নিয়োগকৃত দুজন সিকিউরিটি গার্ড সমুদ্রে ঝাঁপ দেন।

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই এলপিজি সোফিয়ার অদূরে নোঙর করে থাকা বসুন্ধরা গ্রুপের অপর একটি জাহাজ বিএলপিজি চাতকির ক্যাপ্টেন ফরমান উল্ল্যাহ আনসারি বিপদ বুঝতে পেরে দ্রুত জাহাজের ইঞ্জিন চালু এবং নোঙর তুলে এলপিজি সোফিয়ার কাছে চলে যান।

ক্যাপ্টেন ফরমানের নির্দেশনা অনুযায়ী উপস্থিত টাগবোট তুফান এঙপ্রেস, সী ফাইটার৩ এবং সোনাইছড়ি৪ নামের টাগবোট দিয়ে সাগরে ঝাঁপ দেওয়া নাবিকদের উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন।

ক্যাপ্টেন ফরমান এ সময় রেডিওতে পোর্ট কন্ট্রোল, নেভি এবং কোস্ট গার্ডকে ঘটনার কথা জানান। খবর পেয়ে কোস্টগার্ডের অগ্নিনির্বাপক টাগবোট বিজিসিএস প্রমত্ত দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিভানোর কার্যক্রম শুরু করে। পরে নৌবাহিনী ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আরো দুটি অগ্নিনির্বাপক টাগবোট প্রমত্তের সাথে যোগ দেয়। সাগরে ভাসতে থাকা নাবিকদের সকলকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত ৩১ জন নাবিককে নৌবাহিনী এবং কোস্ট গার্ডের মেডিকেল টিম চিকিৎসা প্রদান করে।

আগুন নিভানোর অভিযানে যোগ দেওয়া কোস্ট গার্ডের একজন কর্মকর্তা আজাদীকে জানান, গ্যাসের আগুন ভয়াবহ। এই ধরনের আগুন নিভানোর অভিজ্ঞতা আমাদের তেমন একটা নেই। তিনি বলেন, টানা ৪০ মিনিট ধরে পানি ছিটানোর পরেও আগুন নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রভাব পড়েনি। দাউ দাউ করে জ্বলছিল। তবুও আমরা তিন দিক থেকে আগুনের উপর বিপুল বেগে পানি দিচ্ছিলাম। পানির তোড়ে আগুন কিছুটা কমে আসলেও আবারো দপ করে জ্বলে ওঠে এবং একই গতিতে জ্বলতে থাকে।

এলপি গ্যাসের আগুন পানিতে নিভানো কঠিন বলে মন্তব্য করে অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, এলপিজি গ্যাসের আগুন পানিতে নিভে না। গ্যাস ফুরিয়ে গেলে আগুনের তীব্রতা কমে আসে। শুরুতে আগুন ধরেছিল জাহাজের কার্গো ট্যাংক ২, ৩ ট্যাংকগুলোর উপরে। বাম দিকের ম্যানিফোল্ডে (পাইপলাইন কানেকশন) আর মাস্ট রাইজারে।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এলপিজি সোফিয়াতে ৩ হাজার টন এলপি গ্যাস বোঝাই করা হয়েছিল। আগুনে এই গ্যাস পুরোপুরি পুড়ে গেছে। প্রতি টন ৬২২ ডলার দরে আমদানিকৃত এই গ্যাসের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় সাড়ে ২২ কোটি টাকা বলে সূত্রটি জানায়। সূত্র জানিয়েছে, ক্যাপ্টেন নিকোলাস জাহাজের কার্গো পাইপে বিস্ফোরণ হলেও ওই জাহাজে থাকা এলপিজির তেমন ক্ষতি হয়নি। কিছু গ্যাস বেরিয়ে পুড়ে গেলেও বাল্ব বন্ধ করে দেওয়ায় পরবর্তীতে কার্গো ট্যাংকে আগুন ছড়ায়নি।

বড় বিস্ফোরণের শঙ্কা : নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ টানা প্রায় ১১ ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে গতকাল দুপুর ১২টা নাগাদ এলপিজি সোফিয়ার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে জাহাজটির ভেতরে পুনরায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে অগ্নিনির্বাপণী ও উদ্ধারকারী দল এখনও কাজ চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কোস্ট গার্ড পূর্ব জোনের গণমাধ্যম কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার খন্দকার মুনিফ তকি।

গত রাতে শেষ খবরে জানা গেছে, জাহাজটিতে তখনো ধিকিধিকি করে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছিল। কুণ্ডুলি করে কালো ধোঁয়া বের হচ্ছিল জাহাজটি থেকে।

২৫ বছর বিদেশি অয়েল ট্যাংকারে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সিনিয়র ক্যাপ্টেন আতিক ইউ খান আজাদীকে বলেন, জ্বালানিবাহী মাদার ভ্যাসেলগুলোতে উঁচুমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে। এগুলো কড়াকড়িভাবে মেইনটেইন করা হয়। ক্যাপ্টেন নিকোলাস জাহাজের যে কার্গো বা গ্যাস পাইপ বিস্ফোরিত হয়েছে সেগুলো সার্টিফাইড এবং উচ্চ চাপে টেস্ট করা থাকে। এরপরও কি করে পাইপে বিস্ফোরণ ঘটল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, গ্যাসের চাপ সবসময় উপরের দিকে থাকে। তাই এখন প্রচণ্ড চাপে গ্যাস বের হচ্ছে এবং তা বাইরে পুড়ছে বা পুড়েছে। গ্যাসের চাপ কমে গেলে আগুন ভিতরের দিকে গিয়ে জাহাজটির ট্যাংকে ঢুকে যাবে। তখন বড় ধরনের বিস্ফোরণের শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই জাহাজটির কাছে যেসব জাহাজ বা উদ্ধারকারী দল রয়েছে তাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। দুর্ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন, দুই জাহাজেরই নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অফিসার, ক্রুদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, কম্পিটেন্সি আর অপারেশনের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হলো বলে মন্তব্য করেন ক্যাপ্টেন আতিক ইউ খান।

উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি : বহির্নোঙরে এলপিজিবাহী দুটি দেশিবিদেশি জাহাজে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে সরকার গুরুত্বের সাথে নিয়েছে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নৌপরিবহন এবং বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কুতুবদিয়া অ্যাংকরেজে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন নিকোলাস ও এলপিজি সোফিয়া জাহাজে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা প্রদান করেন। উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৯ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (হারবার অ্যান্ড মেরিন) কমোডর এম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে গঠন করা কমিটিতে নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ডিজিএফআই, এনএসআই, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধি রয়েছেন। কমিটিকে আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

তদন্ত কমিটিকে দুটি জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটন, এলপিজি পরিবহনে জাহাজ এবং জাহাজসমূহের নাবিকদের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, পরিবাহিত এলপিজির পরিবহন ও উপযুক্ততা নিরূপণ, অগ্নি দুর্ঘটনার ফলে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতি ও দায়দায়িত্ব নিরূপণ, ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশ প্রণয়ন এবং সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয় পর্যালোচনা পূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করতেও নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

নৌ পরিবহন উপদেষ্টার উদ্বেগ : এলপিজিবাহী দুটি জাহাজে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। সাম্প্রতিক সময়ে জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ব্যাপারে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে এবং বহির্নোঙরে অবস্থানকারী জাহাজের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে বাড়তি নিরাপত্তা প্রদানের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআর নির্বাচন না করার ঘোষণা অলির
পরবর্তী নিবন্ধ৩ লাখ মানুষে মুখর সৈকত, আড়াইশ প্রতিমা বিসর্জন