আগামী এপ্রিলের মধ্যে দুই হাজার কোটিরও বেশি টাকার ইক্যুইপমেন্টে সমৃদ্ধ হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি)। ইতোমধ্যে ১৪টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ শতাধিক ইক্যুইপমেন্ট টার্মিনালটিতে স্থাপন করেছে সৌদি আরবের রেড–সী গেটওয়ে টার্মিনাল লিমিটেড। আগামী এপ্রিলের মধ্যে বহরে যুক্ত হচ্ছে চারটি ‘কী গ্যান্ট্রি ক্রেন’। তখন থেকে টার্মিনালটি পুরো সক্ষমতায় কন্টেনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কন্টেনার টার্মিনাল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে পিসিটি। চিটাগাং ড্রাইডক লিমিটেডের পাশ থেকে বোট ক্লাবের পর্যন্ত আগেকার বিমানবন্দর সড়কের বাঁকগুলো সোজা করে উদ্ধার করা নদী পাড়ের ৩২ একর জায়গার উপর পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়। এই টার্মিনালের তিনটি জেটিতে চট্টগ্রাম বন্দরের এযাবতকালের সবচেয়ে ‘বড়’ জাহাজগুলোকে অনায়াসে বার্থিং দেয়া যাবে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে যে, বাড়তি গভীরতার পাশাপাশি চ্যানেলে কোনো বাঁক না থাকায় পিসিটি বড় জাহাজ ভিড়ানোর সুবিধা পাবে। এই টার্মিনালে ২০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের এবং ১০ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের মোহনা থেকে এনসিটি, সিসিটির দূরত্ব যেখানে ১৪–১৫ কিলোমিটার সেখানে পিসিটির দূরত্ব মাত্র ৬ কিলোমিটার। যা চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনালগুলোর তুলনায় পিসিটিকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটির নির্মাণকাজ শুরু করে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে দেশিয় প্রতিষ্ঠান ই–ইঞ্জিনিয়ারিং এটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণকাজ শেষ হলেও নানা কারণে পিসিটি চালু হয়নি। পরবর্তীতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের আওতায় সৌদি আরবের রেড সী গেটওয়ে লিমিটেডের সাথে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে টার্মিনালটি পরিচালনার ব্যাপারে চুক্তি হয়। গতবছরের ৮ জুন থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে জাহাজ বার্থিং এবং কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের অনুমোদন প্রদান করে।
সরকারি অনুমোদন মিললেও ইক্যুইপমেন্ট সংকটসহ বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে পুরোদমে কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে কী গ্যান্ট্রি ক্রেন না থাকায় এই টার্মিনালে কেবলমাত্র গিয়ার্ড ভ্যাসেল (নিজস্ব ক্রেন আছে এমন জাহাজ) অপারেট করা হচ্ছে। জাহাজের ক্রেন দিয়েই রপ্তানি পণ্য বোঝাই কন্টেনার জাহাজীকরণ করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিদেশি অপারেটরের মাধ্যমে টার্মিনাল পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া পিসিটিতে স্বাভাবিকভাবে পূর্ণ সক্ষমতায় কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। ইক্যুইপমেন্টের অভাবে কার্যক্রমে গতি আসেনি। শিপিং সেক্টরের কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বহু ইক্যুইপমেন্টই মার্কেট থেকে কিনে এনে চালু করে দেয়ার সুযোগ নেই। এগুলোর অর্ডার দিলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি প্রস্তুত করে সরবরাহ করে। বহু ইক্যুইপমেন্টের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। পিসিটির জন্য ৪টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের অর্ডার দেয়া হয় চৌদ্দ মাস আগে। সেগুলো এখনো সরবরাহ পাওয়া যায়নি। তবে অন্যান্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইক্যুইপমেন্ট ইতোমধ্যে সংযোজিত হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর সংযোজিত হয়েছে ১৪টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন। ২৫ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩১২ কোটি টাকায় ওই চৌদ্দটি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন কিনেছে বিদেশি অপারেটর। আগামী এপ্রিলের মধ্যে চারটি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন সংযোজিত হলে এই টার্মিনালের ইক্যুইপমেন্ট বহর পুরোপুরি সমৃদ্ধ হবে এবং টার্মিনালটি পূর্ণ সক্ষমতায় কার্যক্রম চালাতে পারবে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রেড–সী গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালের (আরএসজিটিআই) বাণিজ্যিক ও জনসংযোগ বিভাগের প্রধান সৈয়দ আরেফ সারওয়ার গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, আমরা আমাদের সিডিউল অনুযায়ী সবকিছু গুছিয়ে আনছি। ঠিকঠাকভাবেই এগুচ্ছে আমাদের কাজ। আমাদের পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে দুই বছর সময় দেয়া হয়েছিল। আগামী জুন পর্যন্ত আমাদের সময় আছে। তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই আমরা পুরোদমে কার্যক্রম চালাতে পারবো। ইতোমধ্যে স্ক্র্যানার এবং রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ শতাধিক প্রয়োজনীয় ইক্যুইপমেন্ট স্থাপন করা হয়েছে। আগামী এপ্রিলের মধ্যে আমাদের ইক্যুইপমেন্ট বহরের সর্বশেষ সংযোজন চারটি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন বহরে যুক্ত হবে। তখন আমাদের কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ে পুরো গতি আসবে।
তিনি বলেন, আমাদের ১৭০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা ইক্যুইপমেন্ট ক্রয়সহ আনুষাঙ্গিকখাতে ১৬০ মিলিয়ন বা দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সম্পন্ন করেছি।
উল্লেখ্য, দুই বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ২২ বছর এই টার্মিনাল পরিচালনা করবে আরএসজিটিই। এরপর ইক্যুইপমেন্টসহ বন্দরটি যেভাবে থাকে তা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে বলে বন্দর সূত্র জানিয়েছে।
পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে বছরে প্রায় ৫ লাখ টিইইউএস কন্টেনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। ৩২ একর জায়গার উপর নির্মিত টার্মিনালটিতে ১৬ একর ইয়ার্ডসহ বিভিন্ন পশ্চাদসুবিধা এবং ৫৮৪ মিটার দীর্ঘ তিনটি জেটি রয়েছে। জেটি এলাকায় পানির গভীরতা সাড়ে ১১মিটার হলেও ১০ থেকে সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়ানো যাবে। এই টার্মিনালে ১৯০ মিটার লম্বা ও ১০ বা সাড়ে ১০ মিটার ড্রাফটের ৩টি কন্টেনার জাহাজ একসাথে এবং ২২০ মিটার দীর্ঘ ডলফিন জেটিতে ১টি ভোজ্যতেলবাহী জাহাজ ভিড়ানো যাবে। তবে ২১০ মিটার বা বেশি ল্যান্থের জাহাজ ২টির বেশি ভিড়ানো যাবে না বলেও সূত্র জানিয়েছে।
বন্দরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, পিসিটি পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও আরএসজিটিআই চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাশুল পরিশোধ করছে। তারা মাসে কমপক্ষে আড়াই লাখ কন্টেনার হ্যান্ডলিং করার ট্যারিফ প্রদান করার কথা রয়েছে। বর্তমানে প্রতিমাসে চটগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এক লাখ ডলারের মতো ট্যারিফ পাচ্ছে বলেও সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়।












