এনেসথেটিস্টের ভূমিকা ও সমকালীন ভাবনা

ডা. কল্যাণ কুমার বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ১৬ অক্টোবর, ২০২৫ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব এনেসথেসিয়া দিবস। প্রতি বছরের মতো এবারও এ দিনটি পালিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “Anesthesiology and Health Emergencies” অর্থাৎ এনেসথেসিয়া বিষয়ক শারীরিক জরুরি সমস্যাসমূহ। অন্যভাবে বলতে গেলে জরুরি শারীরিক সমস্যয় রোগীর এনেসথেসিয়া। এনেসথেসিয়া প্রদানে এনেসথেটিস্টদের ভূমিকা ।

এনেসথেসিয়া প্রদান করতে হয় দু’ধরনের শারীরিক সমস্যায়। ১। রুটিন অপারেশন ২। জরুরি অপারেশন

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে জরুরি শারীরিক সমস্যার জন্য এনেসথেসিয়া প্রদান নিয়ে। জরুরি অপারেশন সমূহ যেমনঃহার্টের অপারেশন, ফুসফুসের অপারেশন, সিজারিয়ান অপারেশন, এপেনডিক্সের অপারেশন, acute abdomen, ফেলোফিয়ান টিউবের rupture অপারেশন, বিভিন্ন ধরনের abscess cellulites, Ovarian cysts rupture দাঁতের জরুরি অপারেশন এবং অর্থোপেডিক ইমার্জেন্সি অপারেশন সমুহ। এ ধরনের অপারেশনে রোগীর জীবনের ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি। কারণ জরুরি অপারেশনের আগে রোগীর সব ধরনের অপারেশন পূর্ব পরীক্ষানিরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। এছাড়াও রোগীর অপারেশন বহির্ভূত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা যেমনঃউচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, ফুসফুসের সমস্যা, ডায়াবেটিস, থাইরয়েডের সমস্যা, লিভার ও কিডনির সমস্যাগুলো ও এনেসথেসিয়ার জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে যা রোগীর জীবনের ঝুঁকি বহুলাংশে বেড়ে যেতে পারে। এ কথা সহজেই প্রতিয়মান হয় যে, রোগীর রুটিন অপারেশনের চেয়ে জরুরি অপারেশনে জীবনের ঝুঁকি থাকে অনেক বেশি।

১৭৮ তম এনেসথেসিয়া দিবসের থিম ছিলো, ‘কর্মশক্তি এবং সুস্থতা’। শারীরিক সূস্থতার মাধ্যমে কাজের উৎসাহ এবং ঊদ্যম নির্ভর করে। কর্মশক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন উৎসাহ আর আনন্দ। অর্থাৎ প্রতিটি কাজের পেছনে আনন্দকে খুঁজে নিতে হবে।

অবসাদ কাজের গতিকে পেছনে নিয়ে যায়। কোন ভাবেই অবসাদ কাম্য নয়। অবসাদ আর তাড়াহুড়া এনেসথেসিয়ার জটিলতা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়।

১৭৭তম বিশ্ব এনেসথেসিয়া দিবসের থিম ছিলো, ‘সচেতনতাই এনেসথেসিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে’। প্রতি বছরের থিমগুলো এনেসথেসিয়ার উৎকর্ষ সাধন এবং আধুনিক ও নিরাপদ এনেসথেসিয়ার গুরুত্ব বহন করে। প্রতিটি অপারেশনে বিভিন্ন ধরনের এনেসথেসিয়ার প্রয়োজন হয় এবং একমাত্র এনেসথেটিস্টগণ এনেসথেসিয়ার এ গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়াও এনেসথেটিস্টগণ আইসিইউ, এইচ.ডি.ইউ, ক্রিটিক্যাল কেয়ার এবং পেলিয়েটিভ কেয়ারের মতা জটিল বিষয়েও দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

ইদানীং দেখা যাচ্ছে, আইসিইউতে কর্মরত চিকিৎসকগণ নিরাপত্তা জনিত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন এবং মাঝেমধ্যে চিকিৎসকরা রোগীর লোকজন দ্বারা আক্রমণের স্বীকার হচ্ছেন, নিগৃহীত ও শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। এটি কোনভাবে কাম্য নয়। চিকিৎসকদের নিরাপত্তা না থাকলে কোনভাবে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান সম্ভব নয়। আইসিইউতে শতকরা ৮০% রোগী মারা যাবার সম্ভাবনা থাকে, যেহেতু আইসিইউতে সাধারণতঃ ক্রিটিক্যাল রোগীগুলো ভর্তি হয়ে থাকে। ডাক্তাররাও অনেক stress এর মধ্যে থাকেন। কাজেই নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কোনভাবে সুষ্ঠু চিকিৎসা প্রদান সম্ভব নয়।

আধুনিক এনেসথেসিয়ার জনক স্যার ডব্লিও. টি. জি মর্টন ১৮৮৬ সালের ১৬ অক্টোবর এই আমেরিকান ডেনটিস্ট রোগীকে ‘ইথার’ এনেসথেসিয়া প্রয়োগের মাধ্যমে দিনটির শুভ সূচনা করেন। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এনেসথেসিয়া এখন অনেক আধুনিক এবং নিরাপদ। এর সাথে উন্নত মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে নিরাপদ এনেসথেসিয়া এখন হাতের নাগালে।

আমাদের দেশে আজকাল ওপেন হার্ট সার্জারী, এনজিওপ্লাস্টি, লিভার ও কিডনি ট্রান্সপেলেন্ট সার্জারীসহ আরো বড় ধরনের সার্জারী নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হচ্ছে। এসব নিঃসন্দেহে উন্নত ও নিরাপদ এনেসথেসিয়ার অবদান।

এনেসথেসিয়ার প্রকারভেদে রোগের প্রয়োজনে এবং রোগীর অন্যান্য শারীরিক সমস্যা জনিত কারণে এনেসথেসিয়ায় বিপদের ঝুঁকিও বেড়ে যায় বহুলাংশে। তাই এনেসথেসিয়ার পূর্বে অপারেশন জনিত রোগীর শারীরিক পরীক্ষা এবং প্রয়োজনীয় সংশ্লিষ্ট ইনভেস্টিগেশান এবং অপারেশনের আগে রোগীর অন্যান্য রোগের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে বিপদের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

যে সকল রোগ এনেসথেসিয়ার জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, তা হলো

১। ফুসফুস জনিত সমস্যা: শ্বাস প্রশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ফুসফুস। ফুসফুসের কার্যকারিতা ঠিক না থাকলে এনেসথেসিয়ার সমস্যা হতে পারে। ফুসফুসের রোগ যেমনএ্যাজমা, ব্রনকাইটিস, এমফাইসিমা, ফুসফুসে পানি বা বাতাস জমা, এছাড়াও কোন প্রদাহ থাকলে জেনারেল এনেসথেসিয়া অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই এনেসথেসিয়ার পূর্বে রোগীর শ্বাস প্রশ্বাসের কার্যক্রম ঠিক আছে কিনা, তা নির্ধারিত এনেসথেটিস্ট দিয়ে চেক আপ করিয়ে নেয়া দরকার।

২। হৃদরোগ জনিত সমস্যা : হার্ট এবং ফুসফুস আমাদের জীবন ধারনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ। রোগীর উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের ইস্কেমিয়া বা অক্সিজেন স্বল্পতা, ইনফারকশান, ধননীতে ব্লক থাকা, হার্টে পানি আসা, হৃদরোগ জনিতকারণে ফুসফুসে পানি, হার্ট ফেইলিউর এবং হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া। এসব ক্ষেত্রে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। হার্টের কার্যক্ষমতার উন্নতি হলে পরবর্তীতে অপারেশনে এনেসথেসিয়ার বিপদের ঝুঁকি অনেকটা কমে আসবে।

৩। কিডনি জনিত সমস্যা: কিডনি শরীরের একটি প্রয়োজনীয় অঙ্গ, যা শরীরের দুষিত পদার্থগুলো নিঃসরণ করে। কিডনি জনিতরোগ যেমনঃনেফ্রাইটিস, নেফ্রোটিক সিনড্রম এবং একুউড ও ক্রনিক কিডনি ডিজিজ, কিডনি ফেইলিউর যাদের আছে, তাদেরকে এনেসথেসিয়া দেওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ বটে।

৪। লিভার জনিত সমস্যা : লিভার হচ্ছে মানুষের এমন একটি অঙ্গ, যা গ্রহণকৃত খাদ্যদ্রব্যকে বিপাকে সাহায্য করে। লিভার জনিতরোগ যেমনঃহেপাটাইটিস, জনডিস, সিরোসিস ও লিভার ফেইলিউর ইত্যাদি। এসব রোগ প্রতিকারকরার পরে এনেসথেসিয়া দেওয়া উত্তম।

৫। ডায়াবেটিস জনিত সমস্যা। যাদের ডায়াবেটিস রোগ আছে, তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এনেসথেসিয়ায় বিপদের ঝুঁকি বাড়ায় ও অপারেশান পরবর্তী ক্ষতস্থান শুকাতে বিলম্ব করে।

৬। যাদের অনিনিয়ন্ত্রিত ইল্কট্রোলাইট রয়েছে, তাদেরও এটিকে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে আনতে হবে, নয়তো এনেসথেসিয়ার রিকভারী হতে বিলম্ব হতে পারে অথবা রিকভারী নাও হতে পারে।

উল্লেখিত রোগগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে এনেসথেসিয়া প্রদান করলে বিপদের ঋুঁকি অনেকটা কমে যায়।

রোগীর প্রি অপারেটিভ চেকআপ নিরাপদ এনেসথেসিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে অপারেশনের আগে রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে এনেসথেটিস্টগণ অবহিত হতে পারেন ।

নিরাপদ ও মানসম্মত এনেসথেসিয়ার মাধ্যমে রোগীর এনেসথেসিয়া প্রদান রোগীর জীবনের নিরাপত্তা ও মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক: কবিপ্রাবন্ধিক ও চিকিৎসক; প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘আজাদীত্‌ ছাপ্পি না?’
পরবর্তী নিবন্ধসঠিক খাদ্যাভ্যাস ও জাপানের প্রাচীন দর্শন হারা হাচি বু