চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নে করা রিট মামলায় দ্বিধাবিভক্ত রায় দিয়েছে হাই কোর্ট। গতকাল বৃহস্পতিবার বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফাতেমা নজীব চুক্তির প্রক্রিয়া অবৈধ ঘোষণা করেছেন; অপর বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ার তিনটি প্রশ্নে চুক্তির প্রক্রিয়া বৈধ বলে রায় দেন। পরে রিটকারী পক্ষের আইনজীবী কায়সার কামাল বলেন, ‘চুক্তির বৈধতা প্রশ্নে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি রুল অ্যাবসোলিউট করেছেন, আর পিউনি জাজ (অপর বিচারপতি) তিনটি প্রশ্ন খারিজ করেছেন। এরপর এই জাজমেন্ট মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে; তিনি তৃতীয় একটি বেঞ্চ করে দেবেন, সেখানে এ ব্যাপারে দেওয়া রায় চূড়ান্ত হবে।’ এ রায়ের ফলে চুক্তি প্রক্রিয়া চলমান থাকবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এই অবস্থায় কাজ চালিয়ে যাওয়া নৈতিক হবে বলে আমি মনে করি না। যেহেতু জ্যেষ্ঠ বিচারক রুল অ্যাবসোলিউট করেছেন, সেহেতু থার্ড বেঞ্চের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করা প্রয়োজন।’ এনসিটি পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি গত ২৫ নভেম্বর শেষ হয়। এরপর রায়ের জন্য ৪ ডিসেম্বর দিন ঠিক করা হয়। রিটের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, আহসানুল করিম ও কায়সার কামাল। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। খবর বিডিনিউজের।
বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের পক্ষে সংগঠনটির সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন রিট মামলাটি করেন। এতে নৌসচিব, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়। ‘চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালে সবই আছে, তবু কেন বিদেশির হাতে যাচ্ছে’ শিরোনামে গত ২৬ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনসহ এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে এনসিটি পরিচালনায় ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করার নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদনটি করা হয়।
রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৩০ জুলাই হাই কোর্ট রুল জারি করে। রুলে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল পরিচালনায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির চলমান প্রক্রিয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর বেঞ্চ এ রুল জারি করে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চারটি কন্টেনার টার্মিনালের মধ্যে সবচেয়ে বড় এনসিটি। এ টার্মিনালের পাঁচটি জেটির মধ্যে চারটিতে কন্টেনারবাহী বড় জাহাজ এবং অন্য একটি জেটিতে অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলকারী ছোট জাহাজ ভেড়ানো হয়। ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে যত কন্টেনার ওঠা–নামা করে, তার ৪৪ শতাংশই হয়েছে এনসিটিতে।
বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে এনসিটির পাঁচটি জেটি নির্মাণ কাজ শেষ হয়। নির্মাণ কাজে বন্দরের খরচ হয়েছিল ৪৬৯ কোটি টাকা।
এর দুই বছর পর এনসিটির জন্য যন্ত্রপাতি কিনতে বিনিয়োগ করার শর্তে পরিচালনার জন্য বিদেশি অপারেটর নিয়োগে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। তখন বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আগ্রহীও ছিল। পরে সেই দরপত্র বাতিল করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। তারপর টার্মিনালটি পরিচালনার জন্য ২০১২ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরপর দরপত্র সংশোধনের নামে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে পরবর্তীতে মামলা হলে টার্মিনালের ইজারা ঝুলে যায়।
নানা আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২০১৫ সালের ২৫ জুন এনসিটির ৪ ও ৫ নম্বর জেটি পরিচালনায় বন্দরের সঙ্গে চুক্তি করে সাইফ পাওয়ার টেক এবং এর দুই অংশীদার কোম্পানি। সে বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর এনসিটির ২ ও ৩ নম্বর জেটি পরিচালনায় বন্দরের সঙ্গে চুক্তি করে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। দরপত্রের মাধ্যমে দুই বছরের জন্য তারা এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিল। ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর এনসিটিতে কন্টেনার ওঠানামার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।
পরে এনসিটি পরিচালনায় আর দরপত্র ডাকা হয়নি। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) প্রতি ছয় মাসের জন্য এনসিটির টার্মিনালগুলো পরিচালনা করে আসছিল সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড।
টানা ১১ বার সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এনসিটি পরিচালনা করে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড। এরপর চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশতমবারের মত আরও ছয় মাসের জন্য তাদের এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। শুরু থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এনসিটি পরিচালনায় কী–গ্যান্ট্রি ক্রেইন ও রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেইনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ খরচ করেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
এনসিটিতে বছরে ১০ লাখ একক কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা আছে। ২০২৪ সালে দেশি বেসরকারি অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক এনসিটিতে ১২ লাখ ৮১ হাজার একক কন্টেনার হ্যান্ডলিং করে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এনসিটি পরিচালনার ভার বিদেশি অপারেটরের কাছে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তখনই এনসিটি পরিচালনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম আলোচনায় আসে। গত বছরের ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের মত অর্ন্তবর্তী সরকারও এনসিটি পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগে আগ্রহের কথা জানায়।
এবারও আলোচনায় ডিপি ওয়ার্ল্ডের নাম রয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে এ নিয়ে অবস্থান জানানোর পর বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা শুরু হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিক দল, বিভিন্ন বাম সংগঠন, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এনসিটি পরিচালনায় বিদেশি অপারেটর নিয়োগের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে এরইমধ্যে।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশি কোম্পানিকে যুক্ত করার পদক্ষেপ, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোরের উদ্যোগ, স্টারলিংকের ইন্টারনেট সেবা চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশকে ‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধচক্রে’ জড়ানোর চেষ্টা বন্ধের দাবিতে গত ২৭ ও ২৮ জুন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোড মার্চও করেছে কিছু বাম সংগঠন। তবে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে তুলে দিলে ‘নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হবে না’ দাবি করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘বন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা যাদের আনছি তারা পৃথিবীর যে–সব দেশে কাজ করে সেসব কোনো দেশেরই সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েনি।’












