চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম সমৃদ্ধ টার্মিনাল নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) নিয়ে সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছে। এই টার্মিনাল কি বিদেশী অপারেটর দিয়ে পরিচালনা করা হবে নাকি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে দেশীয় অপারেটর নিয়োগ দেয়া হবে নাকি আগের মতো ডিপিএম পদ্ধতিতে অপারেটর নিয়োগ করা হবে তা নিয়ে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। আগামী ৭ জানুয়ারি এই টার্মিনালে ডিপিএম পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া দেশীয় অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেকের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। পরদিন থেকেই এই টার্মিনাল অপারেশন কিভাবে হবে তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় আগামী ২৪ নভেম্বর উচ্চ পর্যায়ের একটি সভা আহ্বান করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে বসছে। অপরদিকে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে আবারো প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল নিয়ে পর্যালোচনায় বসছে মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দরের মোট ৪টি কন্টেনার টার্মিনাল রয়েছে। চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল এনসিটি, জেনারেল কার্গো বার্থ (কন্টেনার ও বাল্ক) এবং পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনাল (পিসিটি)। উপরোক্ত চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটি সবচেয়ে বড় এবং কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের কী গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ আধুনিক যন্ত্রপাতিতেও সমৃদ্ধ। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিলের প্রায় ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয় করে এই টার্মিনাল নির্মাণ করে। টার্মিনালটির অবকাঠামোগত নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর বিদেশী একাধিক কোম্পানি নিজস্ব বিনিয়োগে
ইক্যুইপমেন্ট স্থাপন করে টার্মিনালটি পরিচালনার আগ্রহ দেখিয়েছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নৌ মন্ত্রী শাহজাহান খানের চাপের মুখে সেই দরপত্র বাতিল করা হয়। এতে করে পুরোপুরি তৈরি হয়েও চালু করা সম্ভব হয়নি এনসিটি। পরবর্তীতে সাত বছর পর বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করে এনসিটিকে ইক্যুইপমেন্ট সমৃদ্ধ করে। ডিপিএম পদ্ধতিতে এই টার্মিনালের পাঁচটি জেটিতে কন্টেনার হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় দেশীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেককে। ডিপিএম পদ্ধতিতে সরাসরি নিয়োগ পাওয়া এই প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তির মেয়াদ বেশ কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ বাড়ানো চুক্তির মেয়াদ আগামী ৭ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে। এতে করে ৮ জানুয়ারি থেকে এই টার্মিনালে কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
সূত্র বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের (পিসিটি) মতো নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালেও বিদেশী অপারেটর নিয়োগের উদ্যোগ নেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) ডিপি ওয়ার্ল্ডকে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ছাত্র–গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর এই প্রক্রিয়া কিছুটা থমকে গেলেও বিষয়টি নিয়ে সরকার আবারো অগ্রসর হচ্ছে। তবে এই
প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে ডিপি ওয়ার্ল্ডকে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দিতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে।
অপরদিকে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমেও বন্দর কর্তৃপক্ষ এই টার্মিনাল পরিচালনার ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু তাতেও কয়েক মাস সময় লাগবে। এর বাইরে আগের মতো ডিপিএম পদ্ধতিতে কোনো অপারেটরকে টার্মিনালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। উপরোক্ত তিনটি অপশনের মধ্যে কেবলমাত্র ডিপিএম পদ্ধতিই আগামী মাস খানেকের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, সেক্ষেত্রে আবারো কি আগের অপারেটর সাইফ পাওয়ার আসবে নাকি অন্য কোনো অপারেটর নিয়োগ দেয়া হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে যেভাবে বা যে প্রক্রিয়াই গ্রহণ করা হোক না কেন আগামী মাসের মধ্যেই এই প্রক্রিয়া গুছিয়ে রাখতে হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আগামী ২৪ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক বসছে। বৈঠকে এই টার্মিনাল নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠাতব্য বৈঠকে সংশ্লিষ্ট সকলকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। বৈঠকে এনসিটির বিদ্যমান পরিস্থিতিসহ ভবিষ্যৎ অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে আলোচনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
অপরদিকে ওই বৈঠকে দেশের আগামী একশ’ বছরের বন্দর হিসেবে বিবেচিত বে টার্মিনাল নিয়েও পর্যালোচনা করা হবে। বে টার্মিনাল নিয়ে গত ১০ নভেম্বর বিশ্বব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠকের পর এবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এককভাবে বসছে। আগামী ২৪ নভেম্বর অনুষ্ঠাতব্য বৈঠকে প্রকল্পটির সার্বিক অবস্থা, এটি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাসহ সার্বিক বিষয় আলোচিত হবে বলে আভাস দিয়ে সূত্র বলেছে, বৈঠকে বে টার্মিনালের ব্যাপারে একটি অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করা হবে।
উল্লেখ্য, হালিশহরের উপকূলীয় এলাকার ৯৩৯ একর ভূমিসহ সাগর ভরাট করে গড়ে তোলা প্রায় আড়াই হাজার একর জমিতে বে টার্মিনাল গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ, ডিপি ওয়ার্ল্ডসহ বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির বিনিয়োগের প্রস্তাব রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক আগামী ২৪ নভেম্বর ঢাকায় উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক রয়েছে জানিয়ে বলেন, বৈঠকে বে টার্মিনাল এবং নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে।