এনবিআর থেকে সরানো হলো মতিউরকে

সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ থেকেও বাদ পড়েছেন দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ২৪ জুন, ২০২৪ at ৫:৪৯ পূর্বাহ্ণ

১৫ লাখের ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমানকে এনবিআর থেকে সরিয়ে নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গতকাল এ বিষয়ে জারি করা এক আদেশে বলা হয়, এনবিআরের পদ থেকে সরিয়ে মতিউর রহমানকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে উপসচিব মকিমা বেগম স্বাক্ষরিত ওই আদেশে মতিউর রহমানের নতুন দায়িত্ব সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। এ বিষয়ে মতিউর রহমানের প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।

এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, মতিউর রহমান বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে থাকবেন অর্থমন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে। তাকে নতুন কোনো দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। পরবর্তী নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করবেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। খবর বিডিনিউজের।

সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদও হারাচ্ছেন : এনবিআরের পদ হারানোর পর রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদ থেকেও বাদ পড়ছেন রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মতিউর রহমান। কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট মতিউর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে সরকার মনোনীত পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এদিন সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সভা হলেও মতিউর তাতে যোগ দেননি বলে জানান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম।

ব্যাংকের চেয়ারম্যান জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী পর্ষদ সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, তাকে (মতিউর রহমান) ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ।

২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিন বছরের জন্য সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদে দায়িত্ব পেয়েছিলেন মতিউর রহমান। তাকে যে ওই দায়িত্ব থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, সে ইঙ্গিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গতকাল সকালেই দিয়েছিলেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ দিয়ে থাকে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ তা বাস্তবায়ন করে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের (সংশোধিত ২০২৩) এর ১৫() ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষায়িত ব্যাংক ব্যতীত অন্য কোনো ব্যাংককোম্পানিকে উহার পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত, পুনঃনিযুক্ত বা পদায়নের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন গ্রহণ করিতে হইবে এবং এইরূপ নিযুক্ত কর্মকর্তাগণকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে তাহার পদ হইতে অব্যাহতি দেওয়া, বরখাস্ত করা বা অপসরাণ করা যাইবে না।

২০১৩ সালের আগে রাষ্ট্রায়ত্ব বাণিজ্যক ব্যাংকে সরাসরি পরিচালক নিয়োগ দিতে পারত সরকার। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ নিয়ে মতিউর রহমানকে পরিচালক পদ থেকে বাদ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করল সোনালী ব্যাংক। বতর্মানে সোনালী ব্যাংকের পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। পরিচালক পদে আছেন বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব এ বি এম রুহুল আজাদ, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক দৌলতুন্নাহার খানম, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সাবেক মহাব্যবস্থাপক মোল্লা আবদুল ওয়াদুদ ও হিসাববিদ (সিএ) প্রতিষ্ঠান বসু ব্যানার্জি নাথ অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা অংশীদার গোপাল চন্দ্র ঘোষ। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম পদাধিকার বলে পরিচালক।

মতিউরের দুর্নীতির অনুসন্ধানে দুদক : মতিউর রহমানের অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। সেজন্য দুদকের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেনকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসান ও উপসহকারী পরিচালক সাবিকুন নাহার।

এই কমিটিকে মতিউর রহমানের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে গতকাল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে গত ৪ জুন এই কমিটি করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে কাজও শুরু করেছেন।

কোরবানির জন্য ঢাকার মোহাম্মদপুরের সাদিক এগ্রো থেকে ইফাত নামের এক তরুণের ১৫ লাখ টাকা দামে ছাগল কেনার ফেইসবুক পোস্ট ঘিরে গত দিন দশেক ধরেই রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা চলছে। ছাগল কিনতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন ইফাত। ধানমন্ডির বাসায় ঈদের দিন ছাগলটি কোরবানি দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। তখন ছাগলসহ ইফাতের ছবি জুড়ে দিয়ে অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন, ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাগল কেনার অর্থের উৎস কী?

এ প্রশ্ন ঘিরে সামনে আসতে থাকে ইফাতের পরিচয়। ইফাত নিজেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিসহ পোস্ট দিয়ে ও সংবাদমাধ্যমে বাবার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, তার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এঙসাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের সভাপতি মো. মতিউর রহমান। ইফাতের বাবার পরিচয় ধরে অনেকে প্রশ্ন তোলেন, একজন সরকারি কর্মকর্তার ছেলের বিপুল ব্যয়ে কোরবানির পশু কেনার সামর্থ্য হল কী করে?

অবশ্য ছাগলটি ইফাত শেষ পর্যন্ত কেনেননি বলে দাবি সাদিক এগ্রোর কর্ণধার মোহাম্মদ ইমরান হোসাইনের। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইফাত শুধু ১ লাখ টাকা দিয়ে ছাগলটির বুকিং করেছিলেন। তবে অবশিষ্ট মূল্য পরিশোধ করে ছাগলটি তিনি আর নিয়ে যাননি। বিষয়টি নিয়ে ইফাতের বক্তব্যও এসেছে সংবাদমাধ্যমে। তার দাবি, ইমরান হোসাইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে তার ‘অনুরোধে’ ছাগলটি নিয়ে প্রচারের জন্য এতটা দামের কথা বলে পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি।

মতিউর রহমান এ আলোচনায় ঘি ঢেলেছেন ছেলের পরিচয় অস্বীকার করে। একটি টেলিভিশনের প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত নামে কেউ তার ছেলে বা আত্মীয় নয়, এমন নামে কাউকে চেনেন না পর্যন্ত। তার একটিই ছেলে, তার নাম তৌফিকুর রহমান। এরপর ইফাতের পরিচয় ও পারিবারিক ঠিকুজি নিয়ে ফেইসবুকে নানা তথ্য আসতে থাকে। ইফাতের সঙ্গে মতিউর রহমান এবং পরিবারের অন্যদের ছবিও প্রকাশিত হয়।

এক পর্যায়ে সামনে আসেন ফেনী২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি দাবি করেন, ইফাত তার মামাতো বোনের সন্তান। আর মতিউর রহমানই ইফাতের বাবা। তিনি বলেন, ইফাত এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় পক্ষের (স্ত্রীর) ছেলে। মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ছিলেন শিক্ষা ক্যাডারের সাবেক কর্মকর্তা। সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি নাম লেখান রাজনীতিতে। তিনি এখন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান।

মতিউর রহমান এর আগে ব্রাসেলসে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলের, চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার, ভ্যাট কমিশনারসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৪ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া এ কর্মকর্তা পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, সেসব দুদক তদন্তও করেছে।

দুদিন আগে বেসরকারি এক টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, চারবার দুদক তদন্ত করে দেখেছে, আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। মতিউর সরকারি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসায় জড়িয়েছেন। বিনিয়োগ করেছেন পুঁজিবাজারেও।

বিপুল আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মতিউর ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, একটা গ্রুপ অব কোম্পানির ৩০০ একরের জমিতে আমার একটা অংশ আছে। কোনো কারখানায় আমার বিনিয়োগ আছে। কিন্তু ৩০০ একর জমি বা কারখানার পুরোটা আমার না। আমাদের পরিবারের বিনিয়োগ আছে মাত্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএটি যদি সত্য হয়, খুবই দুঃখজনক
পরবর্তী নিবন্ধখানখানাবাদ ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল আত্মসাতের মামলা