কয়েক বছর আগের কথা। তখন হাতের লেখা পাসপোর্ট ছিল। আন্তর্জাতিক একটি কনফারেন্সে যোগদানের জন্য কানাডায় যাওয়া। কানাডার টরেন্টো বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে আছি ঘণ্টাখানেক হলো। ইমিগ্রেশন অফিসার আমার পাসপোর্ট নিয়ে ভিতরে যে গেলো তাঁর আর দেখা নেই। দেখলাম সে আমার পাসপোর্টটি নিয়ে খুলে কী যেন দেখাচ্ছে এবং কথা বলছে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বিরক্ত হয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞেস করলাম ‘কী সমস্যা?’ ‘আমাকে অপেক্ষা করে রাখা হলো কেন?’ সে বলল, ‘সমস্যা! মানে বড় সমস্যা, তোমার পাসপোর্ট এবং ভিসার জন্ম তারিখ মিলছে না?’ সেটি শুনে আমিও আশ্চর্য হলাম। সে এসে পাসপোর্ট খুলে আমাকে দেখাল কোথায় ভুল হয়েছে। আমি তাঁকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম। হাতের লেখা পাসপোর্ট লিখতে গিয়ে ৩১ এর স্থলে ৩ লিখেছে। পরেরটা হয়তো ভুলে পরেনি। ৩১ এর সমর্থনে তখন আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং পাসপোর্টে থাকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা সহ সকল দেশের ভিসা এবং সেখানে বর্ণিত সঠিক জন্ম তারিখ দেখালাম। অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর সে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, দেশে গিয়ে এ ভুল সংশোধন করে নিবেন। যাক এ যাত্রায় রক্ষা পেলাম।
দেশে এসে নতুন করে ফি জমা দিয়ে কর্তৃপক্ষের ভুলের মাশুল আমার পকেট হতে দিয়ে তাদের করা ভুল সংশোধন করেছিলাম। এখন দেশ অনেক এগিয়েছে। আগের এ অবস্থা নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশের বদৌলতে এমআরপি এবং ই–পাসপোর্টের যুগ চলছে। হাতের লেখা পাসপোর্টের যুগ শেষ হলেও আমরা কি এ বিড়ম্বনা হতে রক্ষা পেয়েছি?
সম্প্রতি আমার পাসপোর্ট নবায়নের জন্য পাসপোর্ট অফিসে যাই। যথারীতি সকল কার্যাদি শেষে পাসপোর্ট জমা দিতে গেলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা বললেন, পাসপোটের্র সকল তথ্য এনআইডি অনুযায়ি হতে হবে। কিন্তু এনআইডিতে ইংরেজি নামে অযসবফ এর স্থলে অযসধফ দেয়া এখানেই বাঁধলো বিপত্তি। পাসপোর্ট অফিসে কর্মকর্তাদের কাছ হতে সব সময় সর্বাত্মক সহযোগিতা পেয়ে থাকি। আমার প্রতি তাঁদের আন্তরিকতা ও সেবার বিষয়ে কমতি কখনো দেখিনি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা পাসপোর্ট দেখে বললেন, ‘এনআইডি সংশোধন করে আসেন, বলে আমার আবেদনটি ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।’ আমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে বললাম, ভাই দেখেন আমার পাসপোর্ট দীর্ঘদিনের, পাসপোর্টে ভিসা রয়েছে, আমার পাসপোর্টে যা আছে তাই থাকবে। এনআইডি হয়েছে মাত্র কয়দিন?’ সে আমার কোন কথাই শুনতে চাইলো না। তার কাজে সে মশগুল, আমার কথা শুনার তার সময় কোথায়? বাধ্য হয়ে আমার বন্ধু বিভাগীয় পরিচালক স্যায়িদ সাহেবকে ফোন করলাম। তাঁকে বিষয়টি বললাম। সে সবকিছু শুনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে দিক নির্দেশনা দিলেন। তাঁর পরামর্শে বিশাল এক ঝামেলা হতে রক্ষা পেলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আচরণ এবং অসহযোগিতামূলক ব্যবহারে খুবই কষ্ট পেলাম।
এখানে উল্লেখ্য যে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের বিভাগীয় পরিচালক স্যায়িদ ভাই। যার অফিসের দরজা সব সময় সবার সেবার জন্য উন্মুক্ত থাকত। তাঁর কাছে গিয়ে সেবা পায়নি এমন কেউ নেই। আমিও যখনি প্রয়োজন তাঁর কাছে গিয়েছি যতটুকু সম্ভব সে সহযোগিতা করেছে। বর্তমানে তিনি খুলনায় কর্মরত থাকলেও সেখান হতে আমাকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছে। কৃতজ্ঞতা জানাই স্যায়িদ সাহেবকে, এ ধরনের উপকারি মানুষ সমাজে আছে বলেই এখনো আমাদের সমাজ এত সুন্দর।
পাসপোর্ট অফিসে গ্রাম হতে আসা অনেকেই এনআইডি জটিলতা এবং নাম ভুল, জন্ম তারিখ ভুল প্রভৃতি কারণে হয়রানির শিকার হচ্ছে। কেন এ হয়রানি, কার ভুলের মাশুল কে দিচ্ছে? কেন আমাদের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে কাজ করেন না? সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে এসব কর্মকর্তাদের বেমানান বলে মনে হয়। যারা সেবা নিতে যায় তারা যেন তাঁদের দয়ার ভিখারি।
জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্ষেপে এনআইডি কার্ড হলো বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য একটি বাধ্যতামূলক নথি। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়া যে কোনো মানুষ এটি পাওয়ার অধিকারী। ২২ জুলাই ১৯৯০ সনে এর প্রচলন শুরু হয়। তখন সেখানে শুধু ব্যক্তির নাম, পিতা ও মাতার নাম, জন্মতারিখ, আইডি নাম্বার, ঠিকানা ছবি ও স্বাক্ষর উল্লেখ ছিল। ২০১৬ সাল হতে দেওয়া কার্ডে একটি ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট কার্ড (আই সি সি) সংযুক্ত রয়েছে। যা চিপ কার্ড নামেও পরিচিত। স্মার্ট কার্ডে এ চিপ কার্ড মেশিনের সাহায্যে রিড করা যায়। এই স্মার্ট কার্ডে নাগরিকের সব তথ্য সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের এনআইডি বিভাগ নাগরিকদের পরিচয়পত্র সরবরাহ করে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি করা। পরবর্তীতে চাকরি, জমি রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট তৈরি, ব্যাংক হিসাব খোলা, মোবাইল সিম কার্ড কেনা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের সংযোগ ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ–সুবিধাসহ গুরুত্বপূর্ণ সবকাজেই এখন জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। স্বাভাবিকভাবে আশা করা গিয়েছিল, পরিচয়পত্রটি নির্ভুল ও ত্রুটিমুক্ত হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় সেবায় অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দায়সারা কাজ করেন, এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের সময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ যে সকল লোকদের দিয়ে শুরু হয়েছিলে তারা ছিল নিতান্তই আনাড়ি। তাদের বাংলা ইংরেজি বানান সম্পর্কে সম্ভবত কোনো ধারণাই ছিলো না। অজস্র বানান ভুলে ভরা এসব জাতীয় পরিচয়পত্রের মালিকেরা এখন এসব শুদ্ধ করার মহাযুদ্ধে লিপ্ত। এসব শুদ্ধ করতে গিয়ে কী যে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। তৈরির সময় একটু সচেতন হলেই এ ধরনের ভুল এড়ানো সম্ভব ছিলো। তাদের ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। টাকা পয়সা, শ্রম সময় সব অপচয় করেও সঠিক সময়ে তার কোনো সুরাহা হচ্ছে না। মানুষ মাত্রই ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন দেশে সাধারণ শ্রমিক শ্রেণির কাজ করে। তাদের কষ্টার্জিত শ্রমের আয় দিয়ে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। এনআইডির ভুলের কারণে এ সকল লোক নিত্য হয়রানির শিকার হচ্ছে। তাদের চোখের পানিতে কর্মকর্তাদের মন গলানো কঠিন। আমি অনেক এনআইডি দেখেছি যেখানে পিতার বয়স এবং ছেলের বয়স সমান। পিতার নামের ঠিক নেই, মায়ের নামের বানান ভুল, ঠিকানায় বানান ভুল। অসংখ্য অসংখ্য ভুলে ভরা এনআইডিকে আমাদের রেফারেন্স বা একমাত্র অনুসরণ যোগ্য মাপকাটি হিসেবে গণ্য করা ঠিক হবে না বিকল্প হিসেবে পাসপোর্ট/এনআইডি/ড্রাইভিং লাইসেন্স/জন্ম নিবন্ধন যেটি সঠিক সেটাকে অনুসরণ যোগ্য হিসেবে বিবেচনায় নেয়া উচিত। এতে জনগণের ভোগান্তি কমবে এবং অসৎ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের লোভ লালসা ও হয়রানি হতে জনগণ মুক্তি পাবে এবং দালাল ফরিয়াদের দৌরাত্ম্য কমবে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।
আধুনিক বাংলাদেশের রূপাকার বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশ হতে স্মার্ট বাংলাদেশের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। ২০৩১ সলের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও উচ্চ–মধ্যবিত্ত আয় নিশ্চিতকরণ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ জ্ঞানভিত্তিক, উচ্চ অর্থনীতির উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রূপান্তরের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচী হাতে নিয়েছেন। ২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশ হবে সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিভিত্তিক, জ্ঞানভিত্তিক এবং উদ্ভাবনী বাংলাদেশ।
সরকারের পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ এবং স্মার্ট জনশক্তি। স্মার্ট জনশক্তি তৈরি হলেই স্মার্ট সেবা জনগণ পাবে।
২০৪১ এর মহাপরিকল্পনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নির্মাণে অবশ্যই আমাদের দেশে ‘স্মার্ট মানুষ’ তৈরি হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবায়ন হবে। স্বপ্নের ‘স্মার্ট জনশক্তি’ গড়ে তোলার জন্য প্রাইমারী পর্যায়ের শিক্ষকদের উপর্যুক্ত প্রশিক্ষণ জরুরি। রাষ্ট্র ও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের যৌথ সমন্বয়ে নিয়মিত নৈতিকতা ভিত্তিক ‘মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং’ এর ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের মনে রাখা উচিত নৈতিকতা জন্ম দেয় সৃষ্টিশীল চিন্তাকে। সৃষ্টিশীল চিন্তা জন্ম দেয় জ্ঞানকে। জ্ঞান জন্ম দেয় শিক্ষাকে। শিক্ষা জন্ম দেয় সভ্যতাকে। সভ্যতা সুরক্ষা দেয় মানুষের অস্তিত্বকে।
মোট কথা জাতীয় পরিচয়পত্র নামে স্মার্ট কার্ডগুলো একেবারেই ভুলে ভরা। এসব নানান সমস্যা কীভাবে সংশোধন সম্ভব তা নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন নাগরিকরা। এ ভুলের জন্য দায়ী কারা? উত্তরে বলা যায় যারা লেখালেখির কাজ করেছে তারাই ভুল করেছে। তাহলে জনগণের দোষটা কোথায়? এমনটাই প্রশ্ন করেছেন অনেকে। আবার অনেকে এর বিপরীত কথাও বলেছেন। অনেক জালিয়াত চক্র জালিয়াতি করার জন্য মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া ঠিকানা ও জন্ম তারিখ দিয়ে প্রতারণা করার কাজে এসব ব্যবহার করেন। এ অভিযোগটিও অস্বীকার করার উপায় নেই। সব সম্ভবের দেশে সকলি সম্ভব। তবুও আমি বলব, সাধারণ মানুষকে হয়রানি মুক্ত করতে হলে, জন্ম নিবন্ধন, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বা এনআইডি যেটি সঠিক এবং নির্ভুল বলে প্রমাণিত হবে সেটিকেই গ্রহণযোগ্যতা বা প্রামাণিক পরিচয়পত্র হিসেবে বিবেচনায় নিলে হয়রানি বন্ধ হবে এবং জনগণ দেশে স্মার্ট সেবা পাবেন। রাতারাতি কোনো কাজই নির্ভুলভাবে করা সম্ভব নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সমস্যা যাই থাকুক না কোনো, সংশ্লিষ্টদের উচিত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে দ্রুত সংশোধন করে বিষয়াবলীকে সহজীকরণ করা প্রয়োজন। নইলে দিনে দিনে মানুষের ভোগান্তি বাড়তেই থাকবে এবং স্মার্ট সেবা দিতে না পারলে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।