জাতীয় পরিচয় পত্র (এনআইডি) নাগরিকের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়। কিন্তু অনেকের এই আইডিতে ভুল হয়েছে। এ জন্যে অনেককে চড়া মূল্য দিতে হয়। অনেকে এই সমস্যা সমাধানে মাসের পর মাস, বছর পর্যন্ত ঘুরেও সমাধানে কঠিন বেগ পেতে হয়। বিড়ম্বনার শিকার হয়। হয়ে যায় ভিকটিম। অথচ বাচ্চাদের জন্ম নিবন্ধন থেকে শুরু করে প্রায় প্রত্যেক কাজে এনআইডি দরকার হয়। কিন্তু ভুল এনআইডি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কেউ ভুলেই থেকে যাচ্ছে। কারণ, এনআইডি সংশোধন করা মহা ঝামেলার কাজ। এ বিষয়ে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যায়।
কেইস স্টাডি –১ : ‘ক’ একজন ভিকটিম। নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ভুলের কারণে তার নাম মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের স্থলে মো: ইসলাম এসেছে। তার নাম, বয়স ও মায়ের নাম সম্পূর্ণ ভুল হয়েছে। এই ভুল সংশোধনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ তার পথ চলা। ইসি কর্তৃক তাকে চাহিদা দিয়েছে অনেক। পরিবারের সকলের জন্ম নিবন্ধন, এনআইডি, কাবিননামা, এফিডেভিডসহ আরো অনেক ডকুমেন্টস। অনেক টাকা পয়সা খরচ করে সব কিছু দেয়া হলেও হলফনামা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যেহেতু শিক্ষাগত যোগ্যতার তার কোনো সনদ ছিল না। যদিও তার পাসপোর্ট দাখিল করা রয়েছে। তার জন্ম নিবন্ধন সনদ, পাসপোর্ট, কাবিননামাসহ অনেক ডকুমেন্টসে তার নাম ও বয়স সঠিক ছিল। তার মায়ের এনআইডিতে তার মায়ের নাম সঠিক ছিল। তবু তাকে অসংখ্য ডকুমেন্টস দাখিল করতে হল। এ সব কাজ করে তার আবেদন নিষ্পত্তি হতে বছরের অধিক সময় লেগে যায়। এই কেইসটি রাঙ্গুনিয়া উপজেলা সংশ্লিষ্ট।
কেইস স্টাডি–২ : ‘খ’ একজন ভিকটিম। তার স্বামীর সাথে তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলো। পরে তার আবার বিয়ে হল। কিন্তু তার এনআইডিতে তার আগের স্বামীর নাম রয়ে গেলো। এখন তার নতুন স্বামীর নাম সংযোজন করতে হবে। তার এনআইডি সংশোধনের সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া সমাপনান্তে দেখা যায় ভিকটিম তার পূর্বের স্বামীর মৃত্যুর সনদ প্রদর্শন করতে পারেননি। তাই তিনি বিজ্ঞ প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালত কর্তৃক এফিডেভিড নিয়ে আসেন। কিন্তু এটি কোনো প্রকারেই ইসির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে নারাজ। ফলে ভিকটিমের কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান স্বামীকে এনে উপস্থিত করার কথা বলা হয়। অবশেষে শ্বশুরকে সাক্ষী করা হয়। এ সবে ‘খ’ দীর্ঘ বিড়ম্বনার শিকার হয়।
কেইস স্টাডি –৩ : ‘গ’ ভিকটিম। তার এনআইডিতে তার নামের শেষে মলিকা আছে সেটা সংশোধন হয়ে মলিনা করার জন্যে তিনি আবেদন করেন। অর্থাৎ ‘কা’ এর স্থলে ‘না’ হবে। এই সংশোধন আবেদন নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ান্তে দেখা গেলো, জেলা নির্বাচন অফিস কর্তৃক তাকে একটা তালিকা দিল মেসেজে। তালিকা অনুযায়ী ভিকটিমকে তার পৈতৃক ওয়ারিশান সনদ দাখিল করার কথা বলা হয়। কিন্তু তার অতিরিক্ত খরচের অর্থ নেই। যেহেতু তার স্বামী ইহলোকে ত্যাগ করেছেন। সন্তানদের পড়ালেখা ও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। তবু গত ৫ আগস্টের পর তিনি বরগুনায় গিয়ে মেম্বার চেয়ারম্যানকে খুঁজে পাননি। ফলে সনদ আনা হল না। তিনি বসবাস করেন চট্টগ্রামে, তার শ্বশুর বাড়ি ঢাকা বিভাগের রাজবাড়িয়া জেলায়, তার বাপের বাড়ি বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলায়। অবশেষে গত ২ অক্টোবর ২০২৪ ইং তারিখে ভিকটিমের আবেদনটি ইসি বাতিল করে দেয়। অবশ্য, ভিকটিমের জেএসসি সনদ, পাসপোর্ট ছিল। এতে তার নাম সঠিক ছিল। কাবিননামায় ভুল ছিল। অনেক কষ্ট করে ওয়ারিশান সনদ এনে তিনি পুনরায় আবেদন করেন। চলতি জানুয়ারি মাসে তার আবেদনটি নিষ্পত্তি হয়।
কেইস স্টাডি–৪: – ভিকটিম ‘ঘ’ হাটহাজারী উপজেলার সদরের নিকটবর্তী এলাকার বাসিন্দা। তার নিজের ও বাবার নাম সংশোধনের লক্ষ্যে তিনি প্রথমে ২০২১ সালে অনলাইনে আবেদন করেন। জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসে অনেক ঘুরাঘুরির পর তিনি একটি এসএমএস পেলেন। এতে বিভিন্ন ডকুমেন্টস দাখিলসহ একটি তদন্তের কথা বলা হয়। সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ধরে তার তদন্ত প্রতিবেদন দেননি। আজ দিবেন, কাল দিবেন, পরে আসেন, বউকে নিয়ে আসেন, পরশু আসেন, দিয়ে দিব এই সব বলে প্রতিবেদন কর্মকর্তা ভিকটিমকে ঘুরাতে থাকেন। ফলে দীর্ঘদিন দিন পর তিনি বাধ্য হয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানান। তাতে কিছুদিনের মধ্যে ভিকটিমের আবেদনটি বাতিল হয়ে যায়। এরপর পুনরায় আবেদন করেন। এতে ভিকটিমের পিতার নাম সংশোধন হলেও তার নাম সংশোধন হয়নি। তাই আবারো আবেদন করতে হয়। এভাবে তিনবার আবেদনের পর গত ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের পর অবশেষে সেপ্টেম্বর মাসে তার নাম সংশোধন হয়। তাকে অন্যান্য ডকুমেন্টসের সাথে কাবিননামা, এফিডেভিড দিতে হয়েছে, সরেজমিনে তদন্ত হয়েছে। দীর্ঘ বিড়ম্বনার পর তার আবেদনটি নিষ্পত্তি হয়েছে। ভিকটিমের নাম সংশোধন হল– মোহাম্মদ বদরুল হোসেন মনসুর কাদেরী। এর আগে ছিল মো: মনছুর কাদেরী। তিনি বললেন, এই দেশে জন্মগ্রহণ করা অপরাধ।
পর্যালোচনা: একটি সংশোধন আবেদন সম্পন্ন করতে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হয়, অপচয় হয়। এরপরও তদন্ত প্রতিবেদনের ও অফিসিয়ালি ঘাবলা থাকে। আবার একটি তারিখে সাক্ষাৎ না হলে অন্য তারিখের জন্যে ঘুরাফেরা করতে হয় জেলা নির্বাচন অফিসে। দীর্ঘ সারিতে দাঁড়াতে হয়। উপরোক্ত কেইস স্টাডিগুলো পর্যালোচনায় দেখা যায়, এই সব অবস্থায় ভিকটিম কী করবেন? যদি তিনি দারিদ্র হয়ে থাকেন। তিনি কি ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করে যাতায়াতের খরচ, পারিবারিক সনদের জন্যে ইউপি খরচ, ইউপি কর্তৃক দায়িত্ব দেয়া মেম্বারের খরচ, চৌকিদারের খরচ, তদন্ত প্রতিবেদনের খরচ, উৎকোচ খরচ, কম্পিউটার অপারেটিং সহ ইত্যাদি খরচ কেন ভিকটিম বহন করবেন? কেন মাস, বছর ঘুরতে হয় একজন ভিকটিমকে? এ সবের কি কোনো সঠিক উত্তর আছে? অথচ অনেক ক্ষেত্রে এনআইডিতে ভুল করেছে ইসির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তাই এটি ইসি ও রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্ব বর্তায়।
কেন একটি আবেদন দীর্ঘদিন পর বাতিল করে দিচ্ছেন? যেমন উপরোক্ত কেইস স্টাডি–৩ এর ভিকটিম ‘গ’ এর আবেদন বাতিল করে দিলেন। কেন তাকে ওয়ারিশান সার্টিফিকেট দাখিল করতে বলা হল? এর দায় কার? অথচ তার নামের একটি অক্ষর সংশোধনের প্রয়োজন ছিল। কেইস স্টাডি–১ এর ভিকটিমের নামের ভুলটা সম্পূর্ণ ইসির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এখানে ভিকটিম ‘ক’ অন্যের দায়ভার বহন করতে গিয়ে অপচয় ও বিড়ম্বনার শিকার। কেইস স্টাডি– ২ এর ভিকটিমের বিষয়টি জটিল। যেহেতু ‘খ’ এর প্রয়োজন স্বামীর নাম সংশোধন করা। নিশ্চয়ই তিনি তার পূর্বের স্বামীর মৃত্যু সনদ দাখিল করতে পারেননি। তাই তাকে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক প্রত্যয়ন পত্র এনে দিতে হল। এখানে তবু সংশয়, সন্দেহ থাকে। যেহেতু এই আধুনিককালে কেউ কারো মৃত্যু সনদ না পাবার তেমন কারণ নেই। যাক, এখানে হলফনামা বা প্রত্যয়নদাতা এই দায়ভার বহন করে নিয়েছেন। কিন্তু এরপরও কেন দ্বিতীয় স্বামীকে সশরীরে উপস্থিত থেকে সাক্ষ্য দিতে বলা হয়? তাইতো ভিকটিম ‘ঘ’ আক্ষেপবশত বললেন, এই দেশে জন্মগ্রহণ করা যেন অপরাধ। মাত্র ৪টি কেইস স্টাডিতে যা তথ্য–উপাত্ত ওঠে এসেছে। তাতে স্পষ্ট হয়েছে মানুষ কেন ভিকটিম হয়। এই সব ভিকটিমের দায়ভার কার? এছাড়াও অসংখ্য মানুষ ভিকটিম হয়ে ঘুরছে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনের অফিসে। মানুষের যেন কষ্টের অন্ত নেই। এই বিষয়ে একজন লেখক, জাতীয় পত্রিকার গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সাবেক ঊর্র্ধ্বতন আমলা আপসোস করে বলেছেন, ভুলের বিষয়টা রহস্যই থেকে গেলো।
করণীয় : একটি আবেদন যেন অবহেলার শিকার না হয়। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এসএমএস প্রদান করা দরকার। এসএমসের জন্যে যেন বারবার জেলা নির্বাচন কমিশন অফিসে যেতে না হয়। প্রথম এসএমএসে চাহিদার সাথে ক্যাটাগরি উল্লেখ, শুনানির তারিখ থাকলে বিষয়টি আরো সহজ হয়। ক্যাটাগরি ভিত্তিক দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসার কর্তৃক এক শুনানিতেই আবেদনটি যেন নিষ্পত্তি হয়।
যে সকল আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট থাকে, সে ক্ষেত্রে আবেদনকারীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টসের ভিত্তিতে সংশোধন পূর্বক তার আবেদন নিষ্পত্তি করা যায়। যেমন, (১) শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ, (২) স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান / কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র। অথবা, (১) জন্ম নিবন্ধন সনদ, (২) পিতামাতার আইডি, (৩) সর্বোচ্চ ২ জন ভাইবোনের আইডি, (৪) স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান /ইউপি চেয়ারম্যান / কাউন্সিলর কর্তৃক প্রত্যয়নপত্র (৫) যদি পাসপোর্ট থাকে তবে পাসপোর্ট। এর চেয়ে বেশি তথ্যের দরকার কি আদৌ আছে? এনআইডি সংশোধনের এই সমস্ত কাজ উপজেলা নির্বাচন অফিসে দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। জাতীয় পরিচয় পত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আরো বিচার–বিশ্লেষণের মাধ্যমে সহজ পন্থা গ্রহণ করা দরকার। এ জন্যে সরকারকে নজর দেয়া প্রয়োজন এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসা দরকার। মানুষ বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি পাক। তাতে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা হয়। লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী।