এডগার অ্যালান পো : রহস্যের বরপুত্র ও আধুনিক ছোটগল্পের রূপকার

আলমগীর মোহাম্মদ | বুধবার , ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

এডগার অ্যালান পো (১৮০৯১৮৪৯) শুধু একজন কবি বা লেখক ছিলেন না; তিনি ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের এক অসামান্য ব্যতিক্রম প্রতিভা যিনি স্বল্পায়ু জীবনে প্রায় তিনটি জনপ্রিয় সাহিত্যঘরানার জন্ম দিয়েছেন এবং আধুনিক ছোটগল্পের কাঠামোকে চিরদিনের জন্য পাল্টে দিয়েছেন। রহস্য, বিষাদ ও মনস্তত্ত্বের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন জগত নির্মাণ করে তিনি নিজেকে ‘রহস্যের বরপুত্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পোর সাহিত্যকর্মে মানব মননের নিগূঢ় রহস্য, জীবনের ঘাতপ্রতিঘাত এবং মৃত্যু ও তার নানারূপ উঠে এসেছে, যা আজও পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।

পো আধুনিক ছোটগল্পকে সুনির্দিষ্ট রূপ দেন তাঁর যুগান্তকারী তত্ত্ব প্রভাবের ঐক্য (Unity of Effect) দ্বারা। তাঁর এই পরিচিতির মূল কারণ হলো তিনি সাহিত্যের উদ্দেশ্য কেবল নৈতিক উপদেশ বা তথ্যের প্রচার নয়; বরং এর প্রধান লক্ষ্য হলো শৈল্পিক সৌন্দর্য সৃষ্টি। এই ধারণাই তাঁকে ইউরোপীয় (Art for Art’s Sake) আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। পো বিশ্বাস করতেন, একটি সফল ছোটগল্পের প্রতিটি শব্দ, চরিত্র ও ঘটনা মিলেমিশে পাঠকের মনে একটি একক, গভীর ও সুনির্দিষ্ট ভাব বা অনুভূতির জন্ম দেবে। লেখককে প্রতিটি ছোটখাটো বিষয়ও সম্পূর্ণ যুক্তি ও সচেতন বিবেচনার মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে, কোনো আকস্মিক অনুপ্রেরণার ওপর নির্ভর করা চলবে না। তিনি সাহিত্যকে নৈতিক বা উপদেশমূলক বার্তা দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের তীব্র বিরোধিতা করেন, যাকে তিনি ‘উপদেশমূলকতার ভণ্ডামি’ (Heresy of the Didactic) বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল তাঁর সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পাঠকদের মনে ভয়, বিস্ময়, সৌন্দর্য বা সত্যের একটি তীব্র অনুভূতি সঞ্চার করা। এই কঠোর শৈল্পিক শৃঙ্খলা ছোটগল্পকে একটি নতুন, সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর সাহিত্যরূপে পরিণত করে। ফরাসি প্রতীকবাদী (Symbolist) কবিরা, বিশেষত চার্লস বোদলেয়ার (Charles Baudelaire) ও স্তেফান মালার্মে (Stephane Mallarme), পোর এই তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং এটিকে ইউরোপে আধুনিকতার ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন।

পোর সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালে দেখা যায় তিনি তিনটি প্রধান জনপ্রিয় জনরার জন্ম দিয়েছেন এবং সেগুলিকে আধুনিকতা দান করেছেন। প্রথমত, তিনি ১৮৪১ সালে ‘দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ’ (The Murders in the Rue Morgue) প্রকাশের মাধ্যমে আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের জন্ম দেন। এই গল্পেই তিনি প্রথম ‘গোয়েন্দা’ নামে কোনো চরিত্র সৃষ্টি করেন সেই চরিত্রটি হলো সি. অগাস্ট ডুপিন (C. Auguste Dupin)। ডুপিন কোনো শারীরিক শক্তি বা পুলিশের প্রথাগত পদ্ধতির ওপর নির্ভর না করে কেবল কঠোর যুক্তি ও সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে অপরাধের সমাধান করেন। পো এই পদ্ধতিকে ‘যুক্তি প্রয়োগের গল্প’ (Tales of Ratiocination) হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি এমন একজন শৌখিন ও তীক্ষ্নধী গোয়েন্দার মডেল স্থাপন করেন, যিনি পুলিশের অক্ষমতা সত্ত্বেও রহস্য উন্মোচন করেন। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল তাঁর শার্লক হোমস চরিত্রটি সৃষ্টিতে সরাসরি পোর ডুপিন চরিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, পো তাঁর লেখা গথিক ও ভুতুড়ে গল্পগুলিতে অতিপ্রাকৃতের চেয়ে মানুষের মনের অন্ধকার দিকটি উন্মোচন করেছেন। তাঁর সেরা ভয়ের গল্পগুলি প্রথম পুরুষে (First-Person) লেখা, যা পাঠককে সরাসরি উন্মাদ বা অপরাধীর মনে প্রবেশ করিয়ে দেয়। ‘দ্য টেলটেল হার্ট’ (The Tell-Tale Heart)-এ এক উন্মাদ খুনির মনস্তত্ত্ব দেখা যায়, যে তার শিকারের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পাওয়ার বিভ্রমের শিকার হয়। আবার ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’ (The Black Cat)-এ ভালোবাসা থেকে ঘৃণা এবং বিবেকবর্জিত অপরাধের মাধ্যমে মানব মনের পৈশাচিক রূপটি তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, ‘দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আসার’ (The Fall of the House of Usher) গল্পে স্থান, চরিত্র এবং মনস্তত্ত্বের রহস্যময় একাকার হয়ে যাওয়া দেখা যায়, যা এক অনিবার্য ধ্বংসের ইঙ্গিত দেয়। এই মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধানগুলি পরে ফিওদর দস্তয়েভস্কি (Fyodor Dostoevsky)-র মতো লেখকদের সাহিত্যে গভীর প্রভাব ফেলে। তৃতীয়ত, পো তাঁর উপন্যাস ‘ন্যারেটিভ অব আর্থার গর্ডন পিম অব নানটাকিট’ (Narrative of Arthur Gordon Pym of Nantucket, ১৮৩৮) এবং অন্যান্য রচনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি ক্রমবর্ধমান মুগ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে দূরভবিষ্যৎ নিয়ে অনুমানভিত্তিক বর্ণনা দেন। জুল ভার্ন (Jules Verne)-এর মতো লেখক পোকে তাঁদের সাহিত্যের পূর্বসূরি হিসেবে সম্মান জানিয়েছেন।

সাহিত্যের বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে পোর কবিতা ছিল তাঁর প্রথম ভালোবাসা। কবিতায় তিনি মূলত সৌন্দর্য, মৃত্যু এবং প্রিয়জনকে হারানোর গভীর বিষাদকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কালজয়ী কবিতা দ্য র‌্যভেন (The Raven, ১৮৪৫) তাঁকে রাতারাতি জাতীয় খ্যাতি এনে দেয়। এটি পোর নান্দনিক ও দার্শনিক আদর্শের নিখুঁত সংমিশ্রণ। এই কবিতায় এক তরুণ পণ্ডিত তাঁর মৃত প্রেমিকার (লেনোর) স্মৃতিতে কাতর, আর একটি কাক এসে শুধু ‘নেভারমোর’ (Nevermore) শব্দটি বারবার উচ্চারণ করে তাঁর মানসিক যন্ত্রণাকে চরম করে তোলে। পো তাঁর কবিতায় অলঙ্কার (Alliteration), অনুপ্রাস (Assonance) এবং অভ্যন্তরীণ ছন্দের (Internal Rhyme) ব্যবহারে এক অদ্ভুত, হান্টিং এবং সাংগীতিক গুণাবলী সৃষ্টি করেন, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘দ্য বেলস’ (The Bells) কবিতাটি। ‘টু হেলেন’ এবং ‘লেনোর’এর মতো অন্যান্য কবিতাতেও আদর্শ সৌন্দর্য এবং সেই সৌন্দর্য হারানোর বেদনা তাঁর কাব্যজগতের প্রধান থিম হিসেবে কাজ করেছে।

পোর সাহিত্য যতটা রহস্যময়, তাঁর নিজের জীবনও ঠিক ততটাই রহস্য এবং ট্র্যাজেডিতে পরিপূর্ণ ছিল। ১৮০৯ সালে বোস্টনে জন্ম নিয়ে শৈশবেই বাবামাকে হারান এবং জন অ্যালান নামক এক ধনী ব্যবসায়ীর কাছে পালকপুত্র হিসেবে বড় হন। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে জুয়ার ঋণের কারণে পড়া ছাড়তে বাধ্য হন। সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ওয়েস্ট পয়েন্ট থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিতাড়িত হন। তিনি প্রথম আমেরিকান লেখক যিনি কেবল লেখালেখি করে জীবিকা নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন, যার ফলে তাঁর জীবনে অর্থনৈতিক দুর্দশা লেগেই ছিল। ১৮৩৬ সালে তিনি তাঁর ১৩ বছর বয়সী পিসতুতো বোন ভার্জিনিয়া ক্লেমকে বিয়ে করেন। ১৮৪৭ সালে ভার্জিনিয়ার অকাল মৃত্যু তাঁকে গভীর বিষাদ ও মাদকের অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তাঁর উপন্যাস ‘আর্থার গর্ডন পিম’এর রিচার্ড পার্কার নামের নাবিকের নরখাদকদের হাতে মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে ১৮৮৪ সালের একটি বাস্তব জাহাজডুবির ঘটনায় একই নামের নাবিকের একই পরিণতির অলৌকিক মিল পোর সাহিত্যকে আরও রহস্যময় করে তোলে। ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর বিড়ালের প্রতি ছিল গভীর ভালোবাসা; তিনি যেকোনো কবিতা লেখা শুরু করার আগে তাঁর প্রিয় এশীয় বিড়ালটিকে কাঁধে তুলে নিতেন।

কিন্তু জীবনে এলান পোর সবচেয়ে বড় রহস্যটি হলো তাঁর মৃত্যু। ১৮৪৯ সালের ৭ অক্টোবর মাত্র ৪০ বছর বয়সে পোর মৃত্যু আজও এক অমীমাংসিত রহস্য। মৃত্যুর আগে তিনি পাঁচ দিনের জন্য নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। যখন তাঁকে বাল্টিমোরের একটি পানশালা ও ভোটকেন্দ্রের কাছে অর্ধঅচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়, তখন তাঁর পরনে ছিল জীর্ণ এবং অন্যের পোশাক। হাসপাতালে তিনি প্রলাপ বকতে বকতে মারা যান।

চিকিৎসকের অনুসন্ধানে উঠে আসা প্রাথমিক কারণ ছিল ‘ডিলিরিয়াম ট্রেমেন্স’ (মদজনিত প্রলাপ), তবে কোনো ময়নাতদন্ত না হওয়ায় সেই কারণ নিশ্চিত করা যায়নি। অন্যান্য তত্ত্বগুলির মধ্যে ছিল: রাজনৈতিক গ্যাং দ্বারা অপহরণ (Cooping), মস্তিষ্কের টিউমার, জলাতঙ্ক, বিষপ্রয়োগ, এমনকি তাঁর বাগদত্তার আত্মীয়দের দ্বারা খুন। এলান পোর সাহিত্য গভীর যুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণ ও রহস্য উন্মোচনের উপর ভিত্তি করে লেখা। তাঁর জীবনাবসান হলো এক জটিল, অমীমাংসিত রহস্যের আবরণে। পোর রহস্যময় মৃত্যু আজও গবেষকদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, এবং তাঁর সাহিত্যিক উত্তরাধিকার আজও বিশ্বের কোটি কোটি পাঠক ও অসংখ্য লেখককে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তিনি আধুনিক সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় নক্ষত্র।

লেখক: প্রাবন্ধিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অনুবাদক ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমাইকেল মধুসূদন দত্ত ও মেঘনাদবধ কাব্য