গত বছরের ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেনার ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের জন্য প্রচুর রক্ত প্রয়োজন বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ খবরে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভিড় করতে শুরু করে তরুণরা। স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে ছুটে আসে তারা। ভোর রাত পর্যন্ত রক্ত দিতে আসা তরুণের সংখ্যা প্রায় হাজার ছাড়িয়ে যায়। যদিও আহত খুব বেশি জনের রক্ত লাগেনি।
চমেক হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকে দায়িত্বরত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসএম বশির উদ্দিন ও মোখলেছুর রহমান ওই সময় জানিয়েছিলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের রক্তদানে শয়ে শয়ে তরুণ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের সামনে ভিড় করে। তবে আগ্রহী রক্তদাতাদের কাছ থেকে দশ ব্যাগ করে রক্ত (চারটি নেগেটিভ গ্রুপের) সংগ্রহ করে রাখেন তারা। যদি প্রয়োজন হয় সে বিবেচনায় ‘ও, এ, বি এবং এবি’ নেগেটিভ রক্তগুলো তারা সংগ্রহ করে রাখেন। সব মিলিয়ে চার গ্রুপের ৪০ ব্যাগ নেগেটিভ রক্ত সংগ্রহ করে রাখা হয়। তবে আগে থেকে পর্যাপ্ত মজুদ থাকায় পজিটিভ গ্রুপের রক্ত সংগ্রহ করতে হয়নি।
ব্লাড ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আহত কিছু সংখ্যক রোগীকে পজিটিভ গ্রুপের রক্ত দিতে হলেও নেগেটিভ কোনো রক্তই সরবরাহ করতে হয়নি। তবে সব ছাপিয়ে ঘটনার পর রক্তদাতাদের ভিড়ের বিষয়টি উঠে আসে আলোচনায়। ওই সময় স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল বলে জানান ব্লাড ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা। কেবল অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা বা বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে নয়, স্বাভাবিক সময়েও স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসছেন রক্তদাতারা। কারো রক্তের প্রয়োজন হলে খবর দিলেই হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই হাজির হন রক্ত দিতে। বলা যায়, এখন হাত বাড়ালেই রক্ত মেলে।
যেভাবে চলছে রক্তদান : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজ খুলে রক্তদান কার্যক্রম চালাচ্ছেন স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা। সিটিজি ব্লাড ব্যাংক, ব্লাড ডোনার সোসাইটি, ব্লাড ডোনেটিং ক্লাব, লামা ব্লাড ব্যাংক, ফটিকছড়ি ব্লাড ডোনার সোসাইটিসহ অনেক সংগঠন গড়ে উঠেছে আগ্রহী রক্তদাতাদের নিয়ে। শুরুতে ১২ জন নিয়ে গড়ে তোলা সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের বর্তমান সদস্য সংখ্যা ২১০ জন। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ইমরান ইমু। তিনিসহ আরো ১১ জন ফেইসবুক গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা এডমিন।
সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের এডমিন মো. আখতার হামিদ নিজ এলাকার নামে গড়ে তুলেছেন লামা ব্লাড ব্যাংক। প্রতিষ্ঠাকালীন বন্ধু ও সহপাঠী আদনান, রুবেল হাসান, আমির, সাকিব, তৌহিদ ইসলামসহ ৭/৮ জন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করলেও সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা এখন ৪০ জন বলে জানান তিনি। এ সংগঠনের মাধ্যমে পার্বত্য জনপদেও স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহ সৃষ্টির কাজ করছেন এসব তরুণ। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমের মাধ্যমে এরই মাঝে পাহাড়ের রক্ত সেনানী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন তারা।
আখতার হামিদ বলেন, সিটিজি ব্লাড ব্যাংক ও লামা ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা দিনে অন্তত ৪০ জনের রক্ত ম্যানেজ করি। বিশেষ করে আমাদের গ্রুপের সদস্যরাই স্বেচ্ছায় রক্তদান করে থাকেন। করোনাকালীন এ সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। বর্তমানে আগের মতোই রক্তদাতার সংখ্যা বাড়ছে।
সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এডমিন ইমরান ইমু বলেন, স্বাভাবিক সময়ে অনেক দূর–দূরান্ত থেকে এসেও রক্তদাতারা রক্তদান করেছেন। কিন্তু করোনাকালীন বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে রক্তদানে আগ্রহ কম দেখা গেছে। অনেকের আগ্রহ থাকলেও যাতায়াত জটিলতায় আসতে পারেননি। অনেকে আবার ঘর থেকে বের হতে চাননি। সব মিলিয়ে করোনাকালে রক্তদানে আগ্রহ কম ছিল। তবে পরিস্থিতি এখন আবার স্বাভাবিক হয়েছে। এখন রক্তদানে আগ্রহীদের সংখ্যা বেড়েছে। আমরা আগের মতোই সাড়া পাচ্ছি।
ফারুক নামে এক থ্যালাসেমিয়া রোগীকে মাসে তিন/চারবার রক্ত দিতে হয়। রক্তের প্রয়োজন হলেই কোনো একটি ব্লাড গ্রুপের সাথে যোগাযোগ করে তার পরিবার। রক্ত পেয়েও যান। রক্ত চেয়ে পাননি এমন ঘটনা খুব কম ঘটেছে বলে জানালেন ফারুকের বড় ভাই মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, যারা রক্ত দিতে আসেন তাদের অনেকে গাড়ি ভাড়াটাও নেন না। ডাবটাও খেতে চান না। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে খান। এখনকার তরুণরা রক্তদানের ব্যাপারে অনেক উদার বলে জানান তিনি।
এদিকে আজ বুধবার পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ভূমিকা রাখছেন তাদেরসহ সাধারণ জনগণকে রক্তদানে উৎসাহিত করাই এ দিবসের উদ্দেশ্য। এদিন বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টিনারের জন্মদিন। নোবেলজয়ী এ বিজ্ঞানী রক্তের গ্রুপ ‘এ, বি, ও, এবি’ আবিষ্কার করেছিলেন।
বিশ্ব রক্তদাতা দিবস উপলক্ষে র্যালি ও রক্তদান কর্মসূচির আয়োজন করেছে সন্ধানী চমেক শাখা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ চত্বরে সকাল ৯টায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান সন্ধানী চমেক শাখার সভাপতি উপমা ধর।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক রক্তদান দিবস পালন এবং ২০০০ সালে ‘নিরাপদ রক্ত’ থিম নিয়ে পালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৪ সালে প্রথম পালিত হয়েছিল বিশ্ব রক্তদান দিবস। ২০০৫ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য অধিবেশনের পর থেকে প্রতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এ দিবস পালনের জন্য তাগিদ দিয়ে আসছে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮ কোটি ইউনিট রক্ত স্বেচ্ছায় দান হয়। এখনও বিশ্বের অনেক দেশে মানুষের রক্তের চাহিদা হলে নির্ভর করতে হয় নিজের পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের রক্তদানের ওপর। অনেক দেশে পেশাদারি রক্তদাতা অর্থের বিনিময়ে রক্ত দান করে। যদিও স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে দেয়া রক্তই ‘নিরাপদ রক্ত সরবরাহের’ মূল ভিত্তি বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
সন্ধানী ও ব্লাড ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, করোনা সংক্রমণের প্রথম বছর (২০২০ সালে) স্বেচ্ছায় রক্তদান কমে যায়। এ ধারা অব্যাহত থাকে ২০২১ সালেও। যদিও রক্তের চাহিদা কমেনি। তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় ২০২২ সালে রক্তদান ফের স্বাভাবিক হতে শুরু করে। চলতি বছর আবারো পুরোদমে স্বাভাবিক হয়েছে।
স্বেচ্ছায় রক্তদান নিয়ে কাজ করে রক্তদাতাদের সংগঠন সন্ধানী। সংগঠনটির চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখার তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে শুধু সন্ধানীর মাধ্যমেই ৪ হাজার ১৩ জন মানুষ স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন চট্টগ্রামে। কিন্তু করোনা সংক্রমণের প্রথম বছর (২০২০ সালে) রক্তদাতার এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৯ জনে। রক্তদানে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকে ২০২১ সালেও। ২০২১ সালে সব মিলিয়ে আড়াই হাজারের কিছু বেশি রক্তদাতা স্বেচ্ছায় রক্ত দান করেছেন। তবে গত বছরে ফের বাড়তে শুরু করে। গত বছরের প্রথম ৫ মাসে দেড় হাজারের বেশি রক্তদাতা স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন। ২০২২ সালে পুরো বছরে রক্তদানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫৬৬ জনে। চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে দেড় হাজারের বেশি রক্তদাতা স্বেচ্ছায় রক্তদান করেছেন বলে সন্ধানী সূত্রে জানা গেছে।
করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় রক্তদাতারা ফের এগিয়ে আসছেন জানিয়ে সন্ধানী চমেক শাখার সভাপতি উপমা ধর বলেন, করোনার কারণে দুই বছর রক্তদানে প্রভাব পড়ে। রক্তদান অনেকটা কমে যায়। তবে চলতি বছর পরিস্থিতি বদলেছে। এখন রক্তদাতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ডাক দিলেই রক্তদাতাদের কাছে আমরা প্রচুর সাড়া পাচ্ছি।
এদিকে ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে এখন প্রতি মাসে ৫ হাজারেরও বেশি ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ হয়। হিসেবে দিনে দুইশর বেশি রক্তদাতা এখানে রক্তদান করে থাকেন বলে চমেক হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।