যুদ্ধের মধ্যে জটিল পরিস্থিতির কারণে মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসনের উপযোগী নয় বলে মনে করছেন ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের সঙ্গে গতকাল রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারছি, তা মন্ত্রীকে আমি ব্যাখ্যা করেছি; কিন্তু পরিস্থিতি বেশ জটিল। সুতরাং এটা প্রত্যাবাসনের জন্য ভালো সময় নয়। তবে এটা নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গাদের অগ্রাধিকার, সরকারের অগ্রাধিকার আর সেই লক্ষ্যের দিকে আমরা কাজ অব্যাহত রাখব। খবর বিডিনিউজের।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা ঢলের শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। এরপর কয়েক মাসের মধ্যে সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারের উখিয়া–টেকনাফে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে ওই এলাকার ক্যাম্পে বসবাস করছিল আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গা। খবর বিডিনিউজের।
বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর থেকে কক্সবাজার ও উখিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বঁাঁশ ও প্লাস্টিকের খুপড়ি ঘরে বসবাস শুরু করে রোহিঙ্গারা। উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও সই করে।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়।
এরপর আসে করোনাভাইরাস মহামারি, রোহিঙ্গাদের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগে ঢিল পড়ে। বিশ্বজুড়ে সেই সঙ্কটের মধ্যেই গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সু চির দ্বিতীয় দফার সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সামরিক জান্তা জেনারেল মিন অং হ্লাইং। সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন আগে চীনের নেতৃত্ব প্রত্যাবাসনের বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে বসেছিল। তার চূড়ান্ত ফল আর পাওয়া যায়নি। ওই সময় বাংলাদেশ আশা করেছিল, ২০২১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে হয়ত প্রত্যাবাসন শুরু করা যাবে।
২০২৩ সালে এসে ত্রিপক্ষীয় ওই উদ্যোগের আওতায় প্রত্যাবাসন শুরুর কাজ কিছুটা এগোলেও আবার থমকে যায়। এর মধ্যে রাখাইনসহ বহু এলাকায় বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ চলছে মিয়ামনার সেনাবাহিনীর।
মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক গোয়েন লুইস বলেন, এই মুহূর্তে মিয়ানমারের অনিরাপত্তা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। বিষয় হচ্ছে, এটা খুবই উত্তেজনাপূর্ণ, কেননা অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে এবং দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই জটিল। এবং মন্ত্রী আমাকে আবারও নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের বিষয় নিয়েই কেবল আলোচনা করছে সরকার। যেটা জাতিসংঘও বলছে।
মিয়ানমারের পরিবেশ যাতে ভালো হয়, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘের কাজের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি রাজনীতিক নই, এটা সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক বিষয়। জাতিসংঘের দিক থেকে মহাসচিবের দপ্তর পরিস্থিতি খুব নিবিড়ভাবে অনুসরণ করছে। নিউ ইয়র্কে আলোচনা চলছে, মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূতের কাজ চলছে। আশা করি, জাতিসংঘ আরও পদ্ধতিগতভাবে সম্পৃক্ত হবে।
আবারও রোহিঙ্গা ঢলের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সীমান্তে অনেক যুদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু এখনো কেউ পার হয়নি। অবশ্য আমাদের কাছে মানবিক বিষয় হলো প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ইস্যুতে আমি মন্তব্য করতে চাই না।
নির্বাচন ও বর্তমান সরকারের বিষয়ে জাতিসংঘের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে গোয়েন লুইস বলেন, অনেক বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয়, মহাসচিব চিঠি পাঠিয়েছেন এবং জাতিসংঘের মুখপাত্রও বক্তব্য দিয়েছেন। সেগুলো জনসম্মুখে রয়েছে এবং সে বক্তব্যই বলবৎ আছে। সুতরাং আমরা বর্তমান সব ইস্যুতেই সরকারের সঙ্গে কাজ করব। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দেশে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, জলবায়ু পরিবর্তন ও এলডিসি উত্তরণের কার্যক্রমের পাশাপাশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হওয়ার কথা জানান তিনি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোচনার কথা উল্লেখ করে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ও পরে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পর সেদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি বেশি নিবদ্ধ হয়েছে। রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তাও অর্ধেকে নেমে এসেছে। আমি বলেছি, রোহিঙ্গা ইস্যু যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্পটলাইটে থাকে। জাতিসংঘের কোঅর্ডিনেটর বলেছেন, এটি নিয়ে জেনিভায় আন্তর্জাতিক ওয়ার্কিং গ্রুপ কাজ করছে এবং এ নিয়ে বৈঠক আসন্ন।