আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচার রোধ এবং প্রণোদনা আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম ঠেকাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে জাহাজ ও কন্টেনার ট্র্যাকিং এবং পণ্য স্ক্যানিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত এই নতুন নির্দেশনা দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে বিরাজিত বেশ কিছু অনিয়ম রোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে জানা যায়।
সূত্র জানিয়েছে, দেশের আমদানি বাণিজ্যে দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের অনিয়ম চলে আসছে। বিশেষ করে মিথ্যা আমদানি দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার অভিযোগ বহু পুরানো। শুধু ওভারইনভয়েসিংই নয়, খালি কন্টেনার আনার ঘটনাও ঘটে। পাথর বালিসহ বিভিন্ন বর্জ্য ভর্তি কন্টেনারও বিভিন্ন সময় ধরা পড়েছে। এই ধরনের ঘটনায় বিদেশী রপ্তানিকারক যতটুকু না জালিয়াতি করে তার থেকে ঢের বেশি হয় আমদানিতে জালিয়াতি। বিদেশ থেকে পণ্য না এনে ডলার পাচার করে দেয়ার মাধ্যমে বহু ব্যবসায়ী শিল্পপতি কোটি কোটি ডলার বিদেশী ব্যাংকে জমা করেছে। কানাডার বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমের শত শত কোটি ডলারের অধিকাংশই আমদানির আড়ালে পাচার করা বলেও সূত্র জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যে কোনো পণ্য আমদানির জন্য শুরুতে এলসি করতে হয়। ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি করা হয়। পরবর্তীতে দেশে পণ্য আসার পর ওই ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি মূল্য পরিশোধ করে টাকা বিদেশে রপ্তানিকারকের একাউন্টে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিদেশী রপ্তানিকারকের সাথে যোগসাজস করে দেশীয় আমদানিকারকেরা টাকা পাচারের মহোৎসবে মেতে উঠেছিল বহু সময়।
একইভাবে পণ্য রপ্তানি নিয়েও অভিযোগের পাহাড় রয়েছে। বিদেশে পণ্য রপ্তানি না করেই প্রণোদনার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে দেয়া কিংবা রপ্তানি মূল্যের নামে বিদেশ থেকে নিজের টাকা এনে কালো টাকা সাদা করার অভিযোগ রয়েছে। এগুলো ঠেকাতে বিভিন্ন সময় সরকার নানাভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। এবার নতুন একটি নির্দেশনা জারি করলো বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে ব্যাংকগুলো কোনো আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে জাহাজ ও কন্টেনার ট্র্যাক করে সেই পণ্য দেশে এসেছে কিনা স্ক্যানিং করে তা নিশ্চিত হতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ফরেন এঙচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্ট’ আমদানি মূল্য পরিশোধে ঝুঁকি কমাতে উপরোক্ত নির্দেশনা জারি করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ওসব ব্যাংক থেকে প্রতিটি এডি শাখাকে বিষয়টি কঠোরভাবে অনুসরণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
অপরদিকে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিশেষ দল বেশ কিছু রপ্তানিকারকের রপ্তানি করা পণ্য ও চালানের মধ্যে গড়মিল খুঁজে পেয়েছেন। ব্যাংকের কাছে তথ্য গোপনসহ বিভিন্ন গোঁজামিল দেয়ার ঘটনাও উদঘাটন করা হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ী চক্র ও পণ্য জাহাজীকরণে জড়িত একটি মহলের সহায়তায় বিদেশে পণ্য পাঠিয়ে বাড়তি আয় করেন। আর এই অপ্রদর্শিত বাড়তি আয় বিদেশে পাচার করা হয়। আবার রপ্তানির প্রকৃত তথ্য গোপন করে বিদেশে অর্থ রেখে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে। অর্থাৎ একশ’ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করে পঞ্চাশ কোটি টাকা দেশে এনে বাকি পঞ্চাশ কোটি টাকা বিদেশে ব্যাংকে রেখে দেয়ার মতো ঘটনাও ধরা পড়েছে। এভাবে অর্থ পাচার ঠেকাতে পণ্যবাহী যানসমূহ ট্র্যাকিং ও স্ক্যানিং করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রপ্তানি খাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ এবং এ খাতকে সুরক্ষা দিতে পণ্যবাহী জাহাজ ও কন্টেনারের মালামালে ট্র্যাকিং করতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে কোনো ধরনের অনিয়ম ধরা পড়লে আইন অনযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা পাওয়ার কথা জানিয়ে করে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপক গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, পণ্য ট্রাকিং করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কোনো ধরনের গোঁজামিল ধরা পড়লে অর্থ ছাড় না করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুুযোগ তৈরি হবে।