এখনো আধিপত্যের লড়াই

শান্তিচুক্তির ২৩ বছরেও পাহাড়ে আসেনি শান্তি

রাঙামাটি ও বান্দরবান প্রতিনিধি | বুধবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার এবং জনসংহতি সমিতির (শান্তি বাহিনী) মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য শান্তিচুক্তি। কিন্তু দীর্ঘ ২৩টি বছর পরও শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে। অস্ত্রের ঝনঝনানি, অপহরণ, হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায় আধিপত্যের জেরে রক্তাক্ত হচ্ছে পাহাড়।
পাহাড়ে বিবদমান চারটি আঞ্চলিক গ্রুপের ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত, কখনো কখনো পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাতে রক্ত ঝরছে পাহাড়ের। এদিকে, চুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর অতিবাহিত হলেও চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে বাড়ছে ক্ষোভ ও হতাশা। চুক্তির আলোকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০১৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হয়। জনবল সংকট এবং বিধিমালা না থাকায় কার্যকর হচ্ছে না ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চুক্তির ফলে পাহাড়ে যোগাযোগ ও পর্যটনের উন্নতি হয়েছে। ২৩ বছরে প্রচুর বিদ্যালয়, কলেজ হয়েছে। সাধারণ মানুষের উন্নয়নে কাজ করেছে সরকার। শিক্ষা খাতে রয়েছে রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ, যোগাযোগ খাতে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় সংযোগ সেতু, পর্যটন খাতে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি সাজেকে পর্যটকদের জন্য নির্মিত টু স্টার মানের হোটেল, রাঙামাটিতে নির্মিত হয়েছে থ্রি স্টার মানের পর্যটন কমপ্লেক্স। কাপ্তাই হ্রদে এখন জেলেরা ইচ্ছামতো মাছ শিকার করতে পারে। চুক্তির আগে সরকার এই হ্রদ থেকে এক কোটি টাকাও রাজস্ব পেত না। এখন প্রতি বছর প্রায় ১৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে। রাঙামাটির কয়েক হাজার পরিবার এখন কাপ্তাই হ্রদের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া দুর্গম পাহাড়ে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের দোরগোড়ায়।
চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), চুক্তি সংশোধনের দাবিতে আন্দোলন করছে ইউপিডিএফ এবং পার্বত্য নাগরিক পরিষদ। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় পার্বত্য জেলাগুলোর সকল শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিত্বকারীদের সমন্বয়ে আরেকবার সরকারকে আলোচনায় বসার দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা বলেন, শান্তিচুক্তির আগে পাহাড়ে তেমন উন্নয়ন হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার শান্তিচুক্তির মাধ্যমে অন্ধকার পাহাড়ে আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছে। খুন, গুমের ইতিহাসে শান্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে এই চুক্তি। তিনি জানান, এক সময়কার স্থানীয় সরকার পরিষদ এখন জেলা পরিষদে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে সরকার। পাহাড়ের সকল সম্প্রদায়ের লোকজন প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাচ্ছে। এটাই আওয়ামী লীগের সরকারের বড় চমক।
রাঙামাটির সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, আমি চুক্তির নেগেটিভ কিছু দেখি না। চুক্তির পর পাহাড়ে উন্নয়ন হয়েছে। শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হলে পাহাড়ে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠী সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে।
জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি বলে মিথ্যাচার করে পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা থেকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে সরে আসতে হবে। তার দাবি, চুক্তির ৯০ শতাংশ ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি ধারাগুলো বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে সরকার। তবে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাস্তবায়নে পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্বকারীদের একসঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। কিন্তু তারা সরকারের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। অস্ত্র ছেড়ে তাদের আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানান তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও জনসংহতি সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক কেএস মং মারমা বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে পাহাড়ের সবগুলো আঞ্চলিক সংগঠন এখন ঐক্যবদ্ধ। তবে অস্তিত্ব রক্ষায় আধিপত্যের লড়াইয়ের খেলা থামেনি। সঠিক সময়ে চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। পাহাড়ে নতুন নতুন সংগঠনের জন্ম হচ্ছে। তার মানে এই নয় যে, চুক্তি বাস্তবায়নের আর কোনো প্রয়োজন নেই। মূলত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই পাহাড়ের সকল সমস্যার অবসান ঘটাতে হবে।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) বান্দরবান জেলা সমন্বয়ক ছোটন কান্তি তঞ্চঙ্গা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়িত হলেও পাহাড়ে প্রকৃত শান্তি ফিরবে বলে ইউপিডিএফ মনে করে না। তিনি বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন প্রয়োজন। পাহাড়ের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারীদের সঙ্গে সরকারের আরেকবার আলোচনা করা দরকার।
পার্বত্য নাগরিক পরিষদ বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি কাজী মুজিবুর রহমান বলেন, পার্বত্য জনপদে এখনো চলছে চাঁদাবাজি, অপহরণ, হত্যা, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা। পাহাড়কে নিরাপদ করতে শান্তিচুক্তি বাতিল করে সকল জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে আলোচনা করে নতুন উদ্যোগ নিতে হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাণী : পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য এলাকার অধিবাসীদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বিশ্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার এক বাণীতে রাষ্ট্রপতি এ কথা বলেন।
শান্তির চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের জাতিগত হানাহানি বন্ধের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র শান্তি বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে গতকাল দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করে বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে জাতির পিতার সুখী-সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
কর্মসূচি : শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আজ বুধবার রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। জনসংহতি সমিতি রাঙামাটি জেলা কমিটির উদ্যোগে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আজ সকাল ১০টায় আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে সকাল ১১টায় হবে আলোচনা সভা। এছাড়া রাঙামাটি রিজিয়ন ও সদর জোনের উদ্যোগে রাঙামাটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘাটে অনুষ্ঠিত হবে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবদলে গেছে পার্বত্য জনপদ
পরবর্তী নিবন্ধ৫৫ মিনিটে ঢাকা!